প্রিয় কাক্কু, আমি আখিঁ। এক সাধারণ মেয়ে, কিন্তু আমার জীবনে ছিল এক অসাধারণ মানুষ—আমার কাক্কু।
আমাদের পরিবারে আব্বু-আম্মু, এক ভাই, দুই বোন, দাদু আর কাক্কু। ছোটবেলায় খেলনা দিয়ে নয়, আমি মানুষ হয়েছি কাক্কুর গল্পে, তাঁর চিঠিতে, তাঁর ছবিতে। আমরা তখন দুবাইয়ে থাকতাম, আর কাক্কু ছিলেন দেশে—দাদুর সঙ্গে। তিনি পড়াশোনা করতেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র মানেই গর্বের জায়গা। কিন্তু কাক্কু শুধু গর্ব ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা।
আব্বু কাক্কুকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। ভাইয়ের যেকোনো ইচ্ছাকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। একদিন কাক্কু ফোনে বললেন, "ভাইয়া একখান বাইক থাকলে কি মজা হতো না?"
সেই এক কথায় আব্বু বাইক পাঠিয়ে দিলেন—লাল রঙের চকচকে বাইক।
যেন একটা স্বপ্ন কাক্কুর হাতে ধরা দিল। তিনি বলতেন, “এই বাইকটা আমার ডানার মতো… এখন আমি উড়তে পারি!” শুধু বাইক নয় আইফোন সহ আরও অনেক কিছুই আব্বু কাক্কুকে দিতো, বাংলাদেশে কেনো পূণ্য পৌঁছানোর আগেই সবার আগে কাক্কুর হাতে পৌঁছাতো, কোনো জিনিসের অভাব রাখিনি।
আমরা মাঝে মাঝে ভিডিও কলে তাঁর বাইকে ঘুরে বেড়ানো দেখতাম গ্রামে ও শহরের রাস্তায়, বন্ধুদের সাথে, কখনও একা বিকেলের রোদে হারিয়ে যেতেন। তাঁর চোখে ছিল হাসি, মুখে ছিল জীবন জয়ের সাহস।
কিন্তু এক বিকেলে… সব কিছু বদলে গেল।
সেদিন আমাদের বাড়িতে এক ফোনকল এলো। শুরুতে কেউ কিছু বলতে পারছিল না। ফোনের ওপাশে শুধু কান্নার শব্দ। তারপর একটা বাক্য— “কাক্কু বাইক এক্সিডেন্ট করেছে…!”
আমার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ঘর নিঃশব্দ হয়ে গেল। দাদু নীরব, আব্বু দূর প্রদেশে ডানাহীন পাখির মত দাবড়াচ্ছে, আম্মু কাঁদতে কাঁদতে নিঃশ্বাস হারাচ্ছিলেন।
আর আমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু একবার চিৎকার করে বলেছিলাম, “তুমি তো বলেছিলে উড়তে চাও, তাহলে পড়ে গেলে কেন কাক্কু?”
তারপর প্রতিরাতে আমি কাক্কুকে স্বপ্নে দেখতাম। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন বাইকের পাশে। কখনো হাসতেন, কখনো শুধু তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। আমি ঘুম ভাঙলে কাঁদতাম, চুপিচুপি তাঁর ছবিতে হাত বুলিয়ে বলতাম, “তুমি না বলেছিলে, বড় হয়ে আমিও তোমার মতো হবো...?”
আজও কাক্কুর সমস্ত জিনিস আমি নিজের কাছে রেখেছি—ঘড়ি, কলম, বাইকের চাবি, এলমেট, মোবাইল, ইত্যাদি, এমনকি শেষবারের পরা শার্ট পেন্ট কাউকে ছুঁতে দেই না। সেগুলো শুধু জিনিস নয়, সেগুলো হচ্ছে আমার ভালোবাসার জীবন্ত প্রমাণ।
আজও কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, “এই পৃথিবীতে তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?” আমি কিছু বলি না, আমি শুধু চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে… কারণ সেখানে আমি কাক্কুকে দেখি।
কারণ ভালোবাসা কখনও মরে না। কাক্কু চলে গেছেন, কিন্তু আমি এখনও তার স্বপ্নে বাঁচি।
লেখক: আখিঁ হাসান
বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা