
যায়যায়কাল ডেস্ক: ২০২০ সাল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করেছে চীন। এতে দেশটি মার্কিন সামরিক শক্তিকে প্রতিহত করতে আরও সক্ষমতা অর্জন করার পাশাপাশি এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বাড়তি সুবিধা পেতে পারে।
স্যাটেলাইট ছবি, মানচিত্র এবং সরকারি নোটিশ বিশ্লেষণ করে আজ শুক্রবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কিংবা চীনা সামরিক বাহিনীর রকেট ফোর্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৩৬টি স্থাপনার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি স্থাপনায় সম্প্রসারণের নিদর্শন আছে। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ন্ত্রণ করে এই পিপলস লিবারেশন আর্মি রকেট ফোর্স (পিএলএআরএফ)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের শেষ অর্থাৎ বর্তমান সময় পর্যন্ত কারখানা, গবেষণা ও পরীক্ষা কেন্দ্রসহ এসব স্থাপনার অধিকৃত জায়গার পরিমাণ ২ কোটি ১০ লাখ বর্গফুট বা ২০ লাখ বর্গমিটারের বেশি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে।
স্যাটেলাইট ছবিতে বর্ধিত স্থাপনাগুলোতে নতুন টাওয়ার, বাংকার ও বার্ম (প্রতিরক্ষার জন্য টিলাজাতীয় স্থান) দেখা গেছে। এসব কিছুই সমরাস্ত্র খাতের উন্নয়নেরর সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনকি কিছু ছবিতে ক্ষেপণাস্ত্রের বিভিন্ন অংশেরও দেখা মিলেছে।
প্যাসিফিক ফোরামের সিনিয়র ফেলো ও ন্যাটোর সমরাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক উইলিয়াম আলবার্ক বলেন, 'বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার প্রক্রিয়া এটি। আমরা এখন নতুন এক বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। চীন এরই মধ্যে দৌড় শুরু করে দিয়েছে ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিচ্ছে।'
তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, নতুন ও উন্নতমানের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে চীন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
সিএনএনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে আশপাশের গ্রাম ও কৃষিজমির জায়গায় এমন অনেক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন স্থাপনা লাখ লাখ বর্গফুট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
চীনের দুটি প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা ঠিকাদার ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ করা আনুষ্ঠানিক তথ্য বিশ্লেষণ এবং পরে ভূ-স্থানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই তথ্যগুলো যাচাই করে সিএনএন এসব স্থাপনা শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে নতুন প্রায় ডজনখানেক স্থাপনা রয়েছে।
সিএনএন ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন-সংক্রান্ত স্থাপনা শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে ৬৫টি স্থাপনার আয়তন সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চীনের উৎপাদন সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়াতে পারে।
এছাড়া সিএনএন রকেট ফোর্সের (পিএলএআরএফ) ৩৭টি ঘাঁটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, গত পাঁচ বছরে এর মধ্যে ২২টি ঘাঁটির সম্প্রসারণ হয়েছে।
২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা ও আধুনিকীকরণের জন্য চীনের নেতা শি জিনপিং শত কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। তার লক্ষ্য দেশের সশস্ত্র বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) দ্রুত একটি 'বিশ্বমানের' যোদ্ধা বাহিনীতে রূপান্তর করা।
চীনের দ্রুত-বর্ধমান পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারের দায়িত্বে থাকা পিএলএআরএফ-কেও শক্তিশালী করেছেন শি। এ বাহিনীকে তিনি বর্ণনা করেছেন 'কৌশলগত প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু এবং পরাশক্তি হিসেবে চীনা অবস্থানের কৌশলগত ভিত্তি এবং জাতীয় নিরাপত্তার মূল' হিসেবে।
বিশ্বের বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনী চীনের, যার সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এ বাহিনীর প্রায় সব সামরিক শাখার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে এই স্থাপনাগুলো। এই বিশ্লেষণ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য সিএনএন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে পূর্ব এশিয়া সফর করেন। সেসময় তিনি শি জিনপিংসহ এশিয়ার বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোতে বাণিজ্য আলোচনা প্রাধান্য পেলেও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে 'সমান তাল' বজায় রাখতে পুনরায় পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন ট্রাম্প। এই নির্দেশের ফলে কয়েক দশক ধরে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
গত ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বেইজিং ও মস্কো পারমাণবিক বিস্ফোরণমূলক কোনো পরীক্ষা চালায়নি। এর পরও অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওয়াশিংটন। কেননা এ দুই দেশই পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম উন্নত অস্ত্র তৈরি ও সেগুলোর প্রয়োগমূলক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে চীন তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বাড়াচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জুন মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০টি নতুন ওয়ারহেড নিজেদের অস্ত্রভান্ডারে যোগ করছে চীন।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মোট অস্ত্রভাণ্ডারের তুলনায় চীনের এই সংখ্যা এখনো অনেক কম। ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টের তথ্য মতে, এ দুই দেশ একসঙ্গে বিশ্বের ৯০ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক।
অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, সিএনএনের বিশ্লেষণে উঠে আসা স্থাপনাগুলো থেকে উৎপাদিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তাইওয়ান দখলের উদ্দেশ্যে যেকোনো সম্ভাব্য চীনা সামরিক অভিযানের মূল শক্তি হবে। বেইজিং স্বশাসিত এই দ্বীপটিকে তার নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
তাইওয়ানকে ঘিরে কোনো সংঘাত শুরু হলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোই হবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে দূরে রাখার মূল কৌশল। এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে উপকূলবর্তী এলাকায় 'অ্যান্টি-অ্যাকসেস ডিনায়াল বাবল' তৈরি করতে সক্ষম হবে চীন। এতে তাইওয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে বাধার মুখে পড়বে ওয়াশিংটন।
অলাভজনক জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা সিএনএনের সহযোগী গবেষণা বিশ্লেষক ও চীনের ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী বিশেষজ্ঞ ডেকার এভেলেথের মতে, পিএলএ চায় তাইওয়ান আক্রমণের উপযোগী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।
তিনি বলেন, 'বন্দর, হেলিকপ্টার ঘাঁটি, সরবরাহ কেন্দ্রসহ তাইওয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে এমন যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে চায় চীন। তারা চায় যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছু ধ্বংস করে বাকিদের দূরে সরিয়ে রাখতে।
পেন্টাগনের ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিএলএআরএফ তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ গত চার বছরে তুলনায় পঞ্চাশ শতাংশ বাড়িয়েছে। এ বছরের শুরুতে নিজেদের সামরিক বাজেট ৭ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ায় চীন।
সবমিলিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় চীনের বিনিয়োগ ২৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডারের এই বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা। এই প্রবণতা বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ফোরামের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী ডেভিড সান্টোরো বলেন, 'আমার মনে হয়, শীতল যুদ্ধ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি সব ক্ষেত্রেই চলছে। তবে ঝুঁকি হলো—এটি যেকোনো সময় প্রকৃত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।'
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা