যায়যায় কাল ডেস্ক : ত্রিপুরাসহ উত্তর–পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে টানা বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। ত্রিপুরায় পরিস্থিতি ভয়াবহ।
গত ৪৮ ঘণ্টায় পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত আগরতলা বিমানবন্দরে রেকর্ড পরিমাণে ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বিমানবন্দরটি অনেকটাই উঁচুতে অবস্থিত হলেও সেখানে আংশিকভাবে পানি প্রবেশ করেছে।
পশ্চিম ত্রিপুরা ছাড়াও অন্যান্য জেলা যেমন সিপাহিজলা, ধলাই, উত্তর ত্রিপুরা, গোমতী, দক্ষিণ ত্রিপুরা ও উনাকোটি অংশিকভাবে জলের তলায় চলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘কমলা সতর্কতা’ জারি করেছে। এই সতর্কতার অর্থ রাস্তাঘাট, নদীনালা ও নিচু এলাকা বিপদগ্রস্ত, বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে এবং ভূমিধস বাড়ছে।
ত্রিপুরার বাংলাদেশ ঘেঁষা খোয়াই জেলার প্রশাসন সর্বোচ্চ ‘লাল সতর্কতা’ জারি করেছে। কারণ, খোয়াই নদের পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩১ বছর পর মধ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলার বিশাল জলাধার ডুম্বুরের (৪১ বর্গকিলোমিটার) এক দিক থেকে জল যাওয়ার গেট বা ‘স্ল্যাপ গেট’-এর তিনটির মধ্যে একটি খুলে দেওয়া হয়েছে। এর জেরে বাংলাদেশের কিছু অংশ প্লাবিত হয়েছে । নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাতেই এই গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে না অবনতি হয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
রাজ্যের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা বুধবার রাতে বলেন, ‘গেট খুলে না দিলে জলাধার ফেটে গোটা অঞ্চল জলের তলায় চলে যেত। কিন্তু গেট খুলে দেওয়ার ফলে এখন নদীনালায় জলের মাত্রা বেড়ে গেছে। কী করা উচিত ছিল, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।’
ত্রিপুরায় মোট ১০টি প্রধান নদীর মধ্যে বুধবার বিকেল পর্যন্ত ৯টি নদীতে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। মনে করা হচ্ছে, রাতে বৃষ্টি হলে আগামীকাল সকালের মধ্যে সব কটি নদীতে পানি বিপৎসীমার ওপরে চলে যাবে। রাজধানী আগরতলায় প্রায় সব প্রধান সড়ক হাঁটুসমান জলের মধ্যে রয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রায় পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে।
বুধবার রাতে আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কার ইঙ্গিত দিয়ে সাধারণ মানুষকে পাকা বাড়িতে, উঁচু স্থানে বা নিরাপদ সরকারি আশ্রয়শিবিরে যেতে বলা হয়েছে।
ত্রিপুরার স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, গত বেশ কয়েক দশকে এ রকম বন্যা তারা দেখেননি। রাজ্য সরকারের তরফে প্রাথমিক ত্রাণের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করা গেছে।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।
বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য জরুরি পরিস্থিতিকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর (এনডিআরএফ) সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর আবেদনও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। রাজ্য সরকার আপাতত আগামীকাল স্কুল ও কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্লাবিত বাংলাদেশের ৮ জেলা: বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে আছে পানিতে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় এমনই অবস্থা ফেনীর তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায়। প্লাবিত হয়েছে এই তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ।
নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিন দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে আছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
টানা বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ছড়া ও নদ-নদী দিয়ে তীব্র বেগে ভারত থেকে আসছে পানি। এতে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
ফেনীর আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এর আগে সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। এবারের বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে কয়েকটি ডিঙি নৌকায় পানিবন্দী মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। উদ্ধারে নামেন ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও।
সর্বশেষ বুধবার বিকেল থেকে পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ছয়টি স্পিডবোটে করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও তিনটি স্পিডবোটে উদ্ধারকাজ শুরু করেছেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডও যুক্ত হচ্ছে। বন্যার কারণে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কসহ স্থানীয় সব গ্রামীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যায় উদ্ধারকাজে সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী ছয়টি স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। আরও ছয়টি স্পিডবোট ফেনীর পথে রয়েছে। বিজিবির সদস্যরাও কাজ করছেন। কোস্টগার্ডও উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে।
বুধবার সকালে নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিনারায়ণপুর, কাজি কলোনি, লইয়ার্স কলোনি, রশিদ কলোনি ও কৃষ্ণরামপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাসাবাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি থই থই করছে।
রশিদ কলোনি এলাকার বাসিন্দা মনু দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় তার বসতঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। সাপ ও পোকামাকড়ের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তার। এ পরিস্থিতিতে রান্নাবান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
খাগড়াছড়ি সদর ও পানছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আরও অবনতি হয়েছে দীঘিনালা উপজেলায়। দীঘিনালায় এখনো হাজারো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। দীঘিনালার সঙ্গে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা ও লংগদু উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলে ভাঙন দেখা দিয়েছে ধুরং নদের বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে।
ফটিকছড়ির ইউএনও মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যায় পাশের রাউজান উপজেলার প্রায় ৮টি ইউনিয়ন এবং হাটহাজারী উপজেলার ৮-১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ছয়টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সীতাকুণ্ডে বৃষ্টির পরিমাণ ১৯৩ মিলিমিটার।
কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
গোমতী নদীর আদর্শ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গোমতীর তীর ঘেঁষে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। চরাঞ্চলের কয়েক হাজার একর সবজিখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
মালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন আজাদ বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে চরের ভেতর বসবাস করেন। গত ১০ বছর গোমতী নদীতে এত পানি দেখেননি।
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে।
বুধবার সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পানির তোড়ে গাজীর বাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সিলেটে বুধবার বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমলেও কমেনি মানুষের ভোগান্তি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফলে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে লোকজন ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকেই এমন বৃষ্টির কারণে ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হননি।
মৌলভীবাজারে মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য প্রধান তিন নদ-নদী ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে, উপচে ৬২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা