
চিংথোয়াই অং মার্মা, থানচি (বান্দরবান): তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের সরকারের আমলে বান্দরবানের থানচিতে কর্মরত থাকাকালীন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের হিসাব সহকারী সুরেন্দ্র ত্রিপুরা’র শূন্য থেকে কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। অফিসের শিক্ষক বদলি-বাণিজ্য, স্লিপ ও বিদ্যালয় সংস্কার প্রকল্পের টাকা লুটসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের এই পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ- স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী তাঁদের ভাষ্যমতে, সুরেন্দ্র ত্রিপুরা’র তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ১৪ বছরে ব্যবধানে নামে-বেনামে শূন্য থেকে কোটি টাকার মালিক সম্পদের বনে গেছেন। তাঁর স্বর্ণালংকার ও শুধু জমিই কিনেছেন ৫০ একরের বেশি জমি। বর্তমানে আলীকদম শিক্ষা অফিসের কর্মরত রয়েছেন।
তিনি একজন সাধারণ কৃষকের সন্তান, অন্য বাসা থেকে পড়ালেখার করতেন। খনন্দকালীন চাকুরী করে তার পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগাতেই হিমশিম খেতেন। একসময় যার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ হয়ে ওঠেন কর্মজীবনে রাজকীয় অধিকারী। যা ‘আলাদিনের চেরাগ পাওয়া’ মতো ব্যক্তির তিনি। হঠাৎ তার এমন বিত্তশালী হওয়ায় এ যেন রূপকথার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।
শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, থানচি উপজেলার দুর্গম রেমাক্রি ইউনিয়নের জুমিয়ার পরিবারের ছেলে সুরেন্দ্র ত্রিপুরা। ২০১০ সালের ১১ আগস্ট ১৬তম স্কেলে থানচি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ পান তিনি। চাকরিজীবনের ১৪ বছরই কাটে থানচিতে। সেখানে থাকাকালে টাকার বিনিময়ে বদলি-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন সুরেন্দ্র। অবৈধ পথে কয়েক কোটি টাকার মালিক হন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তে এসব অভিযোগের প্রমাণ মিললে গত বছরে ২০২৪ সালে ১ এপ্রিল তাঁকে আলীকদমে বদলি করা হয়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানচি সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কোয়াইক্ষ্যং মৌজার নকতোহাপাড়ায় ৫ একর, সাধু যোশেফপাড়ায় ৩ একর ও একটি পুকুর, মরিয়নপাড়ায় ২০ শতক, শচিনবাড়ির রাস্তার পাশে ৫০ শতকের একটি পুকুর এবং সদর ইউনিয়নের থানচি লিক্রি সড়কের ২ নম্বর ওয়ার্ডের শিদুই ম্রোর কাছ থেকে ৫ একর, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুনলাই ম্রোর থেকে ৫ একর ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাংয়া ম্রো থেকে ৫ একর এবং রেইংচং ম্রো থেকে ৫ একর জমি ক্রয় করেন সুরেন্দ্র। এ ছাড়া তিন্দু ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে পদ্দমুখে ৫ একর ও রেমাক্রি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট মদকের রুনসাহ্রাপাড়া ও ক্যমং হেডম্যানপাড়ায় সেগুনবাগানসহ ৩০ একর জমিসহ মোট ৫০ একরের বেশি জমি কিনেছেন তিনি। এসব জমির বাজারমূল্য ১৫ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া রয়েছে স্বর্ণালংকার ও টাকা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চাকরির শুরুর দিকে কোনোরকম দিনাতিপাত করলেও কয়েক বছরেই ব্যাপক পরিবর্তন হয় সুরেন্দ্র ত্রিপুরার। ম্রোঃ সম্প্রদায়ের সহজসরল মানুষের থেকে স্বল্পমূল্যে জমি ক্রয় করে বেশিদামের জায়গা বিক্রি, জমিদখল, ইউএনডিপি শিক্ষকদের ভয়ভীতি করে জায়গা ক্রয়ের বাধ্যতা’সহ শিক্ষক বদলি কাজের কমিশন বাণিজ্যের মূল নায়ক তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক বাসিন্দা ও শিক্ষক জানান, সুরেন্দ্র ত্রিপুরা’র থানচিতে কর্মরত থাকাকালীন শিক্ষা অফিসের দপ্তরের বিভিন্ন কাজের অনিয়মসহ নানা অপকর্ম ও দুর্নীতিতেও জড়িত। শুরুতেই তাঁকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনায় সম্মুখীনে পড়তে হচ্ছে। তদন্তের প্রমাণিত হলে তাঁকে আলীকদমে শিক্ষা অফিসের বদলি করে দেন। অবৈধভাবে গাছ কেঁটে কারেন্ট হাম্বার ভেঙেই দেড় লক্ষ টাকা জরিমানা এবং নারী কেলেঙ্কারি অপকর্মে ধরা খেলে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সমাজ অনুসারে বিভিন্ন গঠনে প্রতিনিধি ও পাড়াপ্রধানে মাধ্যমে প্রথা-বিচারে ২টি শুকর ও ৭০ হাজার টাকার জরিমানা দিতে হয়েছে।
অন্যদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপজেলা শিক্ষা অফিসের হিসাব সহকারী সুরেন্দ্র ত্রিপুরা’র ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল করলেও রিসিভ করেননি। তাই তাঁর বক্তব্য নেয়ার সম্ভব হয়নি।
থানচির সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন বলেন, ১৫ বছর চাকরি করেও ৫০ হাজার টাকা জমানো সম্ভব হয়নি। সুরেন্দ্র কীভাবে এত টাকার সম্পদের মালিক হলেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তাঁর সম্পদের ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবিহিত করেছি। তদন্তের পরে তাঁকে আলীকদম শিক্ষা অফিসের বদলি করা হয়েছে।