রিচার্ড সিলভারস্টেইন: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীন ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটছে। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সামাজিক কল্যাণ, মানবিক সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে। আড়াই শতাব্দী ধরে লালিত একটি জাতীয় অবকাঠামো আমাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে।
কেউ এটা থামাতে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে না। প্রতিরোধের যেটুকু সম্ভাবনা আছে, তা-ও নিরর্থক বলে মনে হচ্ছে।
সিনেটর চাক শুমারের মতো ডেমোক্র্যাট নেতারা ট্রাম্পের আইনগত এজেন্ডার সামনে আত্মসমর্পণ করে নিশ্চুপ হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও ট্রাস্টিরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছেন। বড় আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রাম্পের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। প্রযুক্তি শিল্পের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের লাভের খাতিরে নিজেদের ভোক্তাদের চেয়ে ট্রাম্পের প্রতি বেশি আনুগত্য দেখাচ্ছেন।
বিদেশি ছাত্রদের আটক করা হচ্ছে। আর তারা আটককেন্দ্রগুলোর চার দেয়ালে হারিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে রায় দিলেও কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।
অনেক মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের অগ্রাধিকারগুলো সমর্থন করেন। ৫৪ শতাংশ মার্কিন বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের তুলনায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভালো কাজ করেছেন।
ট্রাম্প ঐতিহাসিক কূটনৈতিক চুক্তিগুলো বাতিল করেছেন। বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের হুমকি দিয়েছেন যে তারা যদি বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি পরিত্যাগ না করে, তবে তাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি গবেষণা সহযোগিতা বাতিল করা হতে পারে।
এরপর এল ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি পণ্য আমদানির ওপর ট্রাম্পের কথায় তার দেশের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার’ দিনে তিনি শাস্তিমূলক কর আরোপ করেছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কুঠারাঘাত করেছেন তিনি। চীনা পণ্য আমদানির ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করেছেন। তার শুল্কনীতির লক্ষ্য বেছে বেছে বা নিশানা করে কোনো দেশ নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে এমন প্রায় সব দেশ। এটি সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণায় বিশ্ব পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। তিনি গত জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বিশ্ববাজার; যার অর্ধেকের বেশি হয়েছে গত কয়েক দিনে। ব্যবসায়ীরা এটিকে একটি ‘হত্যাযজ্ঞ’ ও ‘রক্তস্নান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ট্রাম্পের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি ব্যর্থ চেষ্টা। তার এ আর্থিক নীতি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান, এমনকি গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলবে। মুখ থুবড়ে পড়বে শিল্পকারখানা।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমজীবী মানুষ; যারা দেশ ও বিদেশে চাকরি হারাবেন। গত মাসেই ট্রাম্পের ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক নীতির কারণে ২ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, যেটা শেষবার দেখা গিয়েছিল কোভিড-১৯ মহামারির সময়। ধনাঢ্য অভিজাত ও ট্রাম্পের স্বাভাবিক মিত্রদের তেমন কিছুই হবে না। প্রেসিডেন্টের নতুন শুল্কনীতিতে তারা বিশাল লাভ করবেন।
ট্রাম্প এমন সামরিক জোটগুলো থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, যেগুলো বহু প্রজন্ম ধরে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করছে। ইউরোপকেও তিনি রুশ হুমকির মুখে একা ছেড়ে দিয়েছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলো ফেডারেল কর্তৃত্বের কাছে জিম্মি হলেও বাইরের প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রগুলোকে এত সহজে ভয় দেখানো যায় না। তারা অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। দখলদার বা ত্রাস সৃষ্টিকারীরা সফল হওয়ার জন্য ভয় দেখানোর ওপর নির্ভর ও বলপ্রয়োগ করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে।
কিছু দেশ মনে করে, মার্কিন শুল্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করে একটা চুক্তিতে পৌঁছানোই এখন সবচেয়ে ভালো উপায়। ট্রাম্প বলেছেন, তারা এখন শুল্ক থেকে মুক্তি পেতে সারি বেঁধে অনুরোধ করছে।
ত্রাস সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো অস্ত্র হলো সংহতি, তথা সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। তাঁকে দেখিয়ে দিতে হবে যে আপনি ও আপনার মিত্ররা একসঙ্গে তাঁর চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তখন স্বভাবতই তিনি পিছু হটবেন।
এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। ইউরোপ কখনোই ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে কথা বলেনি। কখনো তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বিশ্বশক্তির বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো এই বিচিত্র ও অনেক সময় বিপরীতমুখী স্বার্থের রাষ্ট্রগুলো কি একটি সাধারণ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে। তারা কি আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের ঐতিহাসিক ঐকমত্যভিত্তিক নীতিমালা ত্যাগ করতে পারবে, যাতে হাঙ্গেরির মতো একগুঁয়ে রাষ্ট্রগুলোকে পাশ কাটানো যায়?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে ইউরোপের ভবিষ্যৎ। যদি এ রাষ্ট্রগুলো ব্যর্থ হয়, তবে কিছু দেশের পরিণতি হতে পারে রাশিয়ার অধীন রাজ্য হিসেবে। এসব দেশ ট্রাম্পের একই রকম হুমকির মুখে পড়তে পারে, যেমনটি তিনি গ্রিনল্যান্ড, মেক্সিকো ও কানাডাকে দিয়েছিলেন।
হিটলারের ইউরোপ দখল ও ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দেওয়ার ইতিহাস এখনো এ মহাদেশকে ছায়ার মতো ঢেকে রেখেছে, যা একবার ঘটেছিল, তা আবারও ঘটতে পারে।
তবে ইউরোপ ও অন্যান্য হুমকির মুখে থাকা রাষ্ট্রগুলোর হাতে এখনো শক্তিশালী প্রতিরোধের উপায় রয়েছে। এর একটি হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কৌশল।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার অধীন থাকা দেশগুলোর উচিত হবে, মার্কিন সরকার, প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তোলা। উচিত ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা যতটা সম্ভব বন্ধ করতে হবে। সে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে, কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করতে হবে, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে এবং আর্থিক নেটওয়ার্ক ছিন্ন করতে হবে।
বিশ্বকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলার থেকে সরে আসা দরকার। বিকল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রটোকল তৈরি করে যতটা সম্ভব কম ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা কমাতে হবে। ট্রাম্পের সৃষ্টি করা বিপর্যয়ের জন্য তাঁকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। ওয়াশিংটনকে পেছনে ফেলে বিশ্বকে নিজস্ব পথে হাঁটতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারব্যবস্থা বিশ্বকে এক সুতোয় গেঁথেছে ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে। কিন্তু আজকের বিশ্বায়ন–ব্যবস্থা একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ ব্যবস্থা থেকে যখন কোনো দেশ হঠাৎ বেরিয়ে গিয়ে একে ধ্বংস করার চেষ্টা করে, তখন পুরো ব্যবস্থাই ধসে পড়ার হুমকিতে পড়ে। এখন বাকি দেশগুলোর উচিত নিজেদের রক্ষা করা এবং টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করা।
যদি ওয়াশিংটনের সাবেক মিত্ররা এখনই নিজেদের মানিয়ে না নেয় বা প্রতিরোধ গড়ে না তোলে, তবে শত্রুরা একে একে তাদের কবজা করে নেবে, যেমন ট্রাম্প দেশের ভেতরে তার বিরোধীদের একে একে নিঃশেষ করছেন কিংবা রাশিয়া যেভাবে হুমকি দিচ্ছে। এটি এক অস্তিত্বের সংকট। এ জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব ও দৃঢ় সংকল্প। যুক্তরাষ্ট্রে হুঁশ ফিরবে, এ আশায় বিশ্ব চার বছর অপেক্ষা করতে পারে না। যদি অপেক্ষা করে, তবে অচিরে রুশ ট্যাংক পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর রাস্তায় গড়াতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা ত্যাগ করুন। তাকে একঘরে রাষ্ট্র হিসেবে দেখুন, যা তার প্রাপ্য। ট্রাম্পকে তার অপরাধের মূল্য দিতে বাধ্য করুন। ঠেকিয়ে দিন সন্ত্রাসীদের বিজয়কে।
রিচার্ড সিলভারস্টেইন একজন মার্কিন লেখক ও বিশ্লেষক। যিনি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়াবলি ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন। তার কাজের মূলধারায় আছে স্বচ্ছতা, মানবাধিকার এবং দখলদারির বিরুদ্ধে অবস্থান।
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা