এম এ ইউসুফ আলী, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী): সাগরে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। কাগজ-কলমে এ নিষেধাজ্ঞা কঠোর হলেও বাস্তবতা ঠিক উল্টো। নিষেধাজ্ঞার কোন প্রতিফলনই নেই সাগরে। বরং প্রতিদিনই ট্রলার যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে।
দেদারসে মাছ শিকার করছে। আবার মাছ ধরা শেষে ঘাটে ফিরছে পুনরায় সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। সমুদ্রে মাছের বংশবিস্তার, বেড়ে ওঠা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আগামী ১১ জুন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলেও পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সমুদ্র জলসীমায় মাছ ধরার যেন রীতিমত প্রতিযোগীতা চলছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য ঘাট চরমোন্তাজ। কিন্তু ঘাটে পৌঁছেই চোখে পড়ে একটি অস্বাভাবিক চিত্র। নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে যত সংখ্যক ট্রলার ঘাটে থাকার কথা, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক কম ট্রলার বাঁধা রয়েছে ঘাটে। সাধারণত নিষেধাজ্ঞার সময় অলস জেলেরা জাল সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকেন। এবার সে দৃশ্যও অনুপস্থিত।
এছাড়া যেসব ট্রলার ঘাটে অবস্থান করছেন সেসব ট্রলারের মধ্যে কোন কোন ট্রলারের জেলেদের নানা তৎপরতা চোখে পড়ে। কোন ট্রলারে বরফ তোলা হচ্ছে, কোন ট্রলারে জাল তোলা হচ্ছে, আবার কোন কোন ট্রলারে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল এবং সিলিন্ডার গ্যাস তোলা হচ্ছে। সাগরে যাওয়ার সব প্রস্তুতিই চলছে পুরোদমে।
সাগরে যাওয়ার এমন প্রস্তুতিকালে কথা হয় চরমোন্তাজ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আনোয়ার মৃধার মালিকানাধীন ট্রলারের মাঝি চাঁন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজ বিকেল কিংবা কাল সকালে সাগরে যাবো। মাছ হলে ৪-৫ দিন থাকবো। আর না হলে ৮-১০ দিন।’ কোথায় গিয়ে মাছ ধরবেন-এমন প্রশ্নে বলেন, ‘সোনারচরের পূর্বদিকে (বঙ্গোপসাগর)। একেক ট্রিপে ২০-৩০মণ মাছ পাই।’
এসময় সমুদ্রগামী জেলে মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘সাগরে এখন ম্যালা (প্রচুর) বোট আছে। টাইগার চিংড়ি, তুলার ডাডি, সাদা চিংড়ি, পোমাসহ বিভিন্ন মাছ ধরে। কাঁকড়াও ধরে। নেটওয়ার্কের বাহিরে গভীর সাগরে গিয়ে মাছ ধরে। সেখানে প্রশাসনের লোকজন যেতে পারে না।’ চাঁন মিয়া ও ইব্রাহিম সঙ্গে কথা শেষ করেই মাঝি-মাল্লাসহ ট্রলার নিয়ে সাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখা যায় এরকম অসংখ্য ট্রলার যাচ্ছে, আবার মাছ ধরে কিছু ট্রলার ঘাটে ফিরেও আসছে।
জানা যায়, গভীর সাগরে গিয়ে শিকার করা মাছ বেচাকেনা চলে সাগর মোহনায়। সেখানে ক্যারিংবোট ব্যবসায়ীরা গিয়ে মাছ কেনেন জেলেদের কাছ থেকে। সোনারচর ও চরহেয়ার সংলগ্ন সাগর মোহনায় গিয়ে দেখা যায় একের পর এক ফিশিং ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসছে। সেখান থেকে ক্যারিংবোটে মাছ তুলে দেওয়া হচ্ছে। ক্যারিংবোটে মাছ দিয়ে কোন কোন ট্রলার তীরে চলে যাচ্ছে। আবার কোন ট্রলার রসদ-সদাই নিয়ে সাগরের উদ্দেশ্যে মাছ ধরতে চলে যাচ্ছে।
উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের বাইলাবুনিয়া ট্রলারের জেলে দুলাল বলেন, ‘বৃষ্টি-বর্ষার সময় নৌপুলিশ তেমন নামে না। যখন সাগর শান্ত থাকে, তখন নৌপুলিশ বোট বা স্পিডবোট নিয়ে সাগরে যায়। আমাদেরকে ধরতে পারলে জরিমানা করে।’
অনেকে না বলতে চাইলেও কিছু ট্রলারের মালিক, মাঝি ও জেলেরা ঘুষ দিয়ে সাগরে গিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তারা বলেন, ‘সব ম্যানেজ করেই তারা সাগরে যান। ট্রলার মালিক ও মৎস্য আড়তদাররা এই ম্যানেজ করেন। মায়ের দোয়া ট্রলারের জেলে শাকিল সিকদার বলেন, ‘ম্যানেজ করে যাইতে হয়। আমরা নিয়মিত মাছ ধরতেছি। অবরোধ দিছে, অনেক দিন চলেও গেছে।’ চরমোন্তাজের জেলে জলিল হাওলাদার বলেন, ‘টাইগারের জোবা চলতেছে। এখন প্রচুর বোট আছে। সব সাগরে গেছে। গভীর সাগরে যায়। সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।’
জেলেরা বলছেন,নিয়ম মানলে পেট চলবে কেমনে? তাদের ভাষ্যমতে, নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া খাদ্য সহায়তা সব জেলে পায় না। খাদ্য সহায়তার তালিকায় যাদের নাম আছে, তারাও সময়মতো এই সহায়তা পায় না। এখনও চাল বিতরণ হয়নি।জেলেদের অভিযোগ, প্রকৃত জেলে নন তবুও অনেক স্বচ্ছল মানুষ এই সহায়তা পাচ্ছেন। তাই নিরুপায় হয়ে সংসারের খরচ চালাতে অনেক জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গাবালী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ দিয়ে থাকলে সেটা ভিত্তিহীন। আমরা অনৈতিক কাজের সাথে কোন প্রকার জড়িত নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জেলেদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিটিং করেছি। ৫৮ দিনের অবরোধ যাতে সকলে মেনে চলে এজন্য লিফলেটও বিতরণ করেছি। আমাদের নৌযান নিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে সমুদ্রে যেতে পারি না। নিয়মানুযায়ী মৎস্য অফিসার বা অন্য সংস্থা আমাদের নিয়ে যাবে, তখন আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে পারবো।’
উপজেলা সামুদ্রিক সৎস্য কর্মকর্তা এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘যারা সাগরে আইন অমান্য করে মাছ ধরতে যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক থেকে দুই বছরের জেল বা জরিমানা করা হবে। আমাদের মৎস্য অফিস থেকে এ ধরণের বার্তা দিয়ে আমরা মাইকিং করেছি এবং লিফলেট বিতরণ করেছি। এরপরও কেউ আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পরিবেশবিদ ও মৎস্য গবেষকদের মতে, এভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরলে সামুদ্রিক সম্পদ ভয়াবহভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও একোয়াকালচার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা সফল করতে হলে প্রথমে নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনেক নিবন্ধিত জেলে চাল পাচ্ছেন না, আর অনিবন্ধিত জেলেরাতো এই সুবিধার আওতায়ই পড়ে না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে অনেকে সাগরে যাচ্ছে বা যাওয়ার চেষ্টা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার অনেকেই অবৈধভাবে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো তারা কিভাবে যাচ্ছে ও এই মাছ কোথায় বিক্রি করছে? কারণ, ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার সময় কিংবা মাছ নিয়ে ফেরার সময় কোনো কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন অবরোধে নদীতে পাহাড়া দিলেও সাগরে পাহাড়া দেওয়ার সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। এই সময়ের দায় কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশের।’
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ‘প্রশাসনিকভাবে দমন করতে না পারলে শুধু ভারতের সাথে মিলিয়ে ৬৫ দিনের পরিবর্তে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং নজরদারির দুর্বলতার কারণে এই নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত সুফল ভোগ করা কঠিন হবে। এভাবে চলতে থাকলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন এবং প্রজনন সুরক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা