যায়যায় কাল প্রতিবেদক : ভালো-মন্দের অভিজ্ঞতায় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন তিন ধাপ পেরিয়ে চতুর্থ ধাপে এসে ঠেকেছে। প্রথম তিন ধাপে ভোট পড়ার যে হার, তাতে এই ধাপেও ভোটার উপস্থিতি বাড়ার আশা দেখছেন না নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা। তবে নির্বাচন কমিশনের আশা, শেষটাও ‘ভালো’ হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলছেন, তিনটা ধাপ তো হয়ে গেল। আশা করি, চতুর্থ ধাপও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। ইতোমধ্যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য প্রশাসন, সরকার যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এ ধাপে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী আরও ইনটেনসিভলি দায়িত্ব পালন করবে।
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নও নয় ইসি। তিন ধাপে যথাক্রমে ৩৬, ৩৮ ও ৩৬ শতাংশ ভোট পড়লেও শান্তিপূর্ণ ভোটের দিকেই মনোযোগ দেওয়ার কথা বলছেন কমিশনাররা।
আলমগীর বলেন, আমরা দুটো দিক দেখি। একটা হল-নির্বাচনটা সুষ্ঠু, সঠিকভাবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে হচ্ছে কিনা। আরেকটা হল শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে কিনা।
লম্বা সময় ধরে চলা এই ভোটযুদ্ধ শেষ করতে সব প্রস্ততিও শেষ করেছে ইসি। বুধবার সকাল ৮টায় দেশের ৬০ উপজেলায় ভোট শুরু হয়ে চলবে একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এর মধ্যে ছয়টি উপজেলায় ইভিএমে এবং বাকিগুলোতে ব্যালট পেপারে ভোট হবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় উচ্চ পর্যায়ের একটি মনিটরিং সেল থাকবে নির্বাচন কমিশনে, যেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থার প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন ও সুসংহত করতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেল গঠন করা হয়েছে।
এ ধাপে তিন পদে মোট ৭২১ জন প্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ২৫১ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬৫ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২০৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ইসি এই ধাপে সাত জনের প্রার্থিতা বাতিল করলেও আদালতের আদেশে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন পাঁচ জন।
বিভিন্ন নির্বাচনি অনিয়মের কারণে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন সংসদ সদস্যকে তলব করেছে এবং অনেক প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন সুষ্ঠু করার ওপর তাগিদ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
এবার উপজেলা ভোটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার চেষ্টায়। তবে বিএনপি ও সমমনারা জাতীয় নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও আসেনি। দলটির যেসব প্রার্থী ভোটে এসেছেন, তারাও কাগজে কলম স্বতন্ত্র প্রার্থী; তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গেল তিন ধাপের ভোটে সিংহভাগ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই জিতেছেন। এছাড়া বিএনপির বহিষ্কৃত কয়েকজনসহ বিভিন্ন দলের দেড় ডজন প্রার্থী জিতেছেন।
এক নজরে চতুর্থ ধাপের উপজেলা ভোট: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে ৬০ উপজেলায় ভোটের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন।
ইসির জনসংযোগ পরিচালক মো. শরিফুল আলম জানান, মঙ্গলবার নির্বাচনি সামগ্রীর সঙ্গে ব্যালট পেপার পাঠানো হয় ১৯৭ কেন্দ্রে। আর ভোটের দিন বুধবার সকালে ৪ হাজার ৯৪৭ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছাবে।
এই ধাপে মোট ৭২১ জন প্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ২৫১ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬৫ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২০৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এ ধাপে চেয়ারম্যান পদে ১ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৩ জন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১ জন ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
ইসি জানিয়েছে, নির্বাচনি এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ থেকে ১৯ জন সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। বিশেষ এলাকায় (পার্বত্য ও দুর্গম এলাকা) সাধারণ কেন্দ্রে ১৯ জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ থেকে ২১ জন সদস্য মোতায়েন থাকছেন।
ভোটের মাঠে নিয়োজিত রয়েছেন শতাধিক নির্বাহী হাকিম। উপজেলাভিত্তিক বিচারিক হাকিমরাও নিয়োজিত থাকবেন। ভোটের আগে-পরে চার দিনের জন্য আরও নির্বাহী ও বিচারকি হাকিম নিয়োজিত থাকবেন।
মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিজিবি ১৬৬ প্লাটুন। ভোটকেন্দ্রে পুলিশ ১৯,৪৭৮ জন। মোবাইল টিমে পুলিশ ৬,০০৩ জন। স্ট্রাইকিং ফোর্সে পুলিশ ২,৬৭৩ জন । র্যাব সদস্য ১৫৪টি টিম । সব মিলিয়ে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে ৪১,৩৭৯ জন । ভোটকেন্দ্র, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সে ৬৬,৫৭৯ আনসার সদস্য থাকবে।
অতিরিক্ত আইন শৃঙ্খলা সদস্য মোতায়েন থাকবে ১৭ উপজেলায়। সেখানে অতিরিক্ত বিজিবি ২৯ প্লাটুন, অতিরিক্ত র্যাব ১৪টি টিম, কোস্টগার্ড ৫ সেকশন ও অতিরিক্ত হাকিম ১৬ জন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৪২% ভোটের হারের পর চার মাসের মাথায় উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৩৭% ভোট পড়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষক ও পযবেক্ষরা বলছেন, সহিংসতা উপজেলা ভোটে না থাকলেও নির্বাচনে ভোটারদের ‘অবসাদ’ অব্যাহত রয়েছে। তিনটি ধাপের পর চতুর্থ ধাপে ভোটার উপস্থিতি যে বাড়বে তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, কমিশনের উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ে সংবিধানে কোনো মাপকাঠি নেই যে এত শতাংশ ভোট পড়লে আমরা কমিশনকে উত্তীর্ণ বলব বা এ প্লাস বলব এধরনের কোনো কিছু নেই। নির্বাচন কমিশন ভোটারদেরকে ভোটকেন্দ্রে টানবে এ ধরনের কিছুও কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে অনুশীলনটা হচ্ছে যখন একটা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, সব দলের অংশগ্রহণ থাকে, তখন তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ পায়।
উপজেলা ভোটে যেহেতু সব দলের অংশগ্রহণ নেই, সেখানে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে ব্যাপক প্রচার চালানোর এক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের আছে বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুল আলীম বলেন, আগে অনেক কমিশনের সময় দেখেছি তারা পরিকল্পনা করে ভোটারদেরকে আগ্রহী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন আর সে কাজগুলো দেখা যায় না। আমার মনে হয় না এবারও খুব বেশি তারতম্য হবে, সব মিলিয়ে ৪০ শতাংশের নিচেই থাকবে ভোটের হার। তার বেশি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে, যেটা আসলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। আলাপ-আলোচনা দরকার, সবাইকে একসঙ্গে বসতে হবে। এখান থেকে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হলো একসাথে বসা।
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের ভাষ্য, ভোটারকে কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না। কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কিনা, আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কিনা- এসব নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষণ করবে। নির্বাচন কমিশন তো সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে করছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু পরিবেশ রাখার জন্য আইনানুগ সব পদক্ষেপই নিচ্ছে, ভোটার যাতে আসে।
তার মতে, এখন ভোটার আনতে হবে প্রার্থী হিসেবে যারা দাঁড়িয়েছেন, তাদেরকে।
তিনি বলেন, ভোটাররা হয়ত আসছে না অনেক কারণে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, সব দলের অংশগ্রহণ হলে ভোটারদের উৎসাহ থাকে, সেটা তো হচ্ছে না। যেহেতু ভোটাররা মনে করছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা কম সেখানে ভোট দেওয়া না দেওয়া তো সমান। প্রতিযোগিতা থাকতে হবে, নিবন্ধিত দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকতে হবে নির্বাচনে, না থাকলে উৎসবমুখর ভোট হবে না।
সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, স্থানীয় সরকারে কিন্তু ভোটারের ঘাটতি থাকে না। যারা ভোটে আসছে না তারা আবার নেগেটিভ প্রচার করছে। সুতরাং যত শতাংশ ভোটার আসছে ভোট দিতে, এরমধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাদের কেন্দ্রমুখী করার চেষ্টা থাকতে হবে প্রার্থীদের। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে হবে, প্রভাবমুক্ত হতে হবে, অংশগ্রহণমূলক থাকতে হবে। না হলে ভোটের হার এরকমই (৩৬-৩৮%) থাকবে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ- জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, ভোটারদের কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব ইসির নয়। ভোট শান্তিপূর্ণ করাই ইসির দায়িত্ব, সেটা ‘ভালোভাবে’ হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও ভোটারদের ‘নির্বাচন অবসাদ’ এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। চতুর্থ ধাপেও ৩৬-৩৮% এর বেশি ভোটার উপস্থিতি হবে না হয়ত; বরং কমতে পারে। এখন নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত।
ষষ্ঠ উপজেলা ভোটে দেশের মোট ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে নির্বাচন উপযোগী সাড়ে চারশ উপজেলায় চার ধাপে ভোট হচ্ছে এবার। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাকিগুলোয় ভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন।
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোট হয় ৮ মে। এসব উপজেলায় গড়ে প্রায় ৩৬% ভোট পড়ে। এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ভোট হয়, তাতে ভোটের হার ৩৮%। আর তৃতীয় ধাপে ২৯ মে ৯০ উপজেলায় ভোট হয়। এ নির্বাচনে ৩৬% ভোট পড়েছে।
প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৮ জন, দ্বিতীয় ধাপে ২২ জন, তৃতীয় ধাপে ১২ জন ও চতুর্থ ধাপে ৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
প্রথম ধাপে ২২টি, দ্বিতীয় ধাপে ২৪টি, তৃতীয় ধাপে ১৮ ও চতুর্থ ধাপে ৬টি উপজেলায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি; বাকিগুলোয় ব্যালট পেপারে ভোট হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী বুধবার উপজেলা ভোটের চতুর্থ ও শেষ ধাপ হলেও ঘূর্ণিঝড় রেমালে স্থগিত ২০ উপজেলার নির্বাচন রয়েছে ৯ জুন।
সম্পাদক ও প্রকাশক :মোঃ আলামিনুল হক,নিবার্হী সম্পাদক :আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল
যোগাযোগ :ফোনঃ +৮৮০২৫৭১৬০৭০০,মোবাইলঃ ০১৭১২৯৪১১১৬,Emails:jaijaikalcv@gmail.com
সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ, আর. এস. ভবন, ৩য় তলা, মতিঝিল, ঢাকা