শুক্রবার, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভুরুঙ্গামারীতে আমন ধান কাটার উৎসব

নুরুল আমিন, ভুরুঙ্গামারী: দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের তিন দিকে সীমান্ত বেষ্টিত উপজেলা ভুরুঙ্গামারীতে শুরু হয়েছে নতুন আমন ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর ব্যস্ততা। উপজেলার বিস্তৃত ফসলের মাঠজুড়ে চলছে সোনালি ধান কাটার উৎসব।

নতুন ধান ঘরে উঠাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণী ও দিনমুজররা। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি।

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কোথাও কৃষকরা দল বেধে ধান কাটছেন আর মনের সুখে গান গাইছেন।

কেউ ধানের আটি বাঁধছেন।কোথাও কৃষক জমিতে বসে কৃষাণীর আনা খাবার খাচ্ছেন। কোথাও ধান কেটে জমা করে রাখা হয়েছে, কোথাও ঘোড়ার গাড়ী, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কোথাও কাঁধে করে কৃষকরা ধান বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজ বসত বাড়িতে । সর্বত্র নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ কৃষকের।

ফসলের মাঠ থেকে কৃষকের বাড়ি সর্বত্র চলছে নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব।

উপজেলার কৃষকরা জানান, এখন পুরোদমে রোপা আমন কাটা শুরু হয়েছে। মাঝারী কুয়াশা-শীতকে উপেক্ষা করে কৃষকরা সকাল-সন্ধ্যা মাঠে কাজ করছেন। কষকরা জানান, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ধান কাটা ও মাড়াই এর কাজ শেষ হবে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে তাহলে অগ্রাহায়ন মাসের মধ্যে ধান শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজ সম্পন্ন হবে।

কৃষক ও দিন মুজুরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক বিঘা জমির ধান কেটে আটি বেধে কৃষকের বাড়ি আনতে তারা ২৫ শত থেকে ০৩ হাজার টাকা চুক্তি নিচ্ছেন। দূরবর্তী স্থান থেকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত ৩ হাজার ৫শ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। একজন দিন মুজুর তার পারিশ্রমিক নিচ্ছেন ৫শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত ।

উপজেলার জয়মনিরহাট ইউনিয়নের কৃষক মাহাবুর রহমান, এবার আমন ধানের ফসলে পরপর তিনবার কীটনাশক ও ছত্রাক নাশক স্প্রে করেছি। এতে করে বিঘা প্রতি তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে । এর আগের মৌসুমে আবাদ করেছিলাম কিন্তু এরকম কোন খরচ হয়নি। জানান তিনি নিজে সঙ্গে থেকে দিন মজুর / কামলা নিয়ে ধান কাটছেন। জমিতে ধান শুকানোর পর দিন মজুর সঙ্গে নিয়ে আঁটি বেঁধে ব্যাটারি চালিত অটো ভ্যান গাড়ি দিয়ে বাড়িতে নিয়েছেন। তার গড় ফলন হয়েছে গুটি লাল স্বর্না বিঘা পতি (৩২/৩৩ শতকে) ১৬ মণ করে। একই ইউনিয়নের কৃষক মাওলানা ফরহাদ হোসেন জানান তার জমিতে পুতি বিঘায় ১৫ মন হারে সিদ্ধ শুকনা ধান ওজন করেছেন।

অপরদিকে একই উপজেলার বড় খাটামারী ব্লকের কৃষক আমিন ডাক্তার জানান তিনি সবেমাত্র ধান কেটে জমিতে ফেলে রেখেছেন শুকানোর জন্য। বাড়িতে এনে মাড়াই ঝাড়াই করে বলা যাবে প্রতি বিঘায় ফলন কত মন করে হয়েছে।

পাথরডুবী ইউনিয়নের মইদাম গ্রামের কৃষক আব্দুল বারেক, জাবেদ আলী জানান, ধানের শিশ মরে গেছে চিটা বেশি হয়েছে। এবার ফলন বেশি ভালো হয় নাই। এসব জমিতে বিঘায় ১৭ থেকে ২০ মণ ধান পাই। সেখানে ১২ থেকে ১৫ মণের বেশি পাওয়া যাবে না। আমরা নিজের জমিতে কাজ করার কারনে কিছুটা লাভ থাকতে পারে। কামলা দিয়ে কাজ করালে লোকসান হত।

দলবাড়ী বিলের কৃষক সাজু জানান, সারে চার বিঘা জমিতে গুটি স্বর্ন জাতের ধান লাগিয়েছি। বিঘায় ১০-১২ মণ ধান হবে। আমার জমিতে পোকার আক্রমন নাই তবে আড়াই বিঘা জমিতে চিটা হয়েছে বেশি। এবার আবাদে আমার ৮-১০ হাজার টাকা লোকসান হবে।

তিলাই ইউনিয়নের কইকুড়ি বিলের কৃষক তফের উদ্দীন ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে রাকিব হাসান জানান, আমাদের জমিতে মাজরা পোকা আক্রমন করলেও ফসল মোটামুটি ভালো হয়েছে। বিঘায় ১৯-২০ মণ ধান ঘরে উঠানো যাবে।

একি ইউনিয়নের সবেদুল বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে আবাদ করেছি। ধান ভালো হয় নাই ছত্রাক আর কারেন্ট পোকার আক্রমনে ধান খারাপ হয়েছে। আমার খরচ তোলাই কষ্ট হবে।

কৃষক নুর ইসলাম জানান, সময় মত বৃষ্টি না হওয়া এবং অসময়ে বৃষ্টি বাতাস হওয়ার কারনে মাজরা পোকা, কারেন্ট পোকা ও ছত্রাকের আক্রমনে ধানের ক্ষতি বেশি হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আগে বিএস অফিসাররা খোঁজ নিত গত কয়েক বছর থেকে বিএস অফিসারদের চোখে দেখি না আমরা গ্রামের মানুষ কার কাছে পরামর্শ নিবো।

কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, কি যে রোগ আইলো বাপু ধানে পোহা (পোকা) নাই খালি চিটা। এবার আবাদে খুব লচ গো।

চর ভুরুঙ্গামারী ইউনিয়নের হোচারবালা এলাকার কৃষক দুদু মিয়া বলেন, আমি পাঁচ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আবাদ ভালো হয়েছে বিঘায় ২০-২২ মন ধান পাবো আশা করছি।

আন্ধারীঝার ইউনিয়নের বীর ধাউরারকুটির কৃষক এরশাদ জানান, হামার এটি ধানের বাম্পার ফলন হইছে, বিঘায় ১৯-২০ মন পামো।

পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা চরের কৃষক আশাদুল ও দিলবর জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবং পোকামাকরের আক্রমণ কম থাকায় এবার আমনের ফলন হয়েছে।

বঙ্গ সোনাটাহাট ইউনিয়নের কৃষক মতি জানান, কিছু জমিতে ধান একটু খারাপ হলেও বেশির ভাগ জমিতে ধান ভালো হয়েছে।

বলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম কেদার খাপারা গ্রামের কৃষক মাহবুব ও রিয়াজুল জানান, ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে প্রতি বিঘায় ১৯-২০ মণের কম হবে না।

উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ভুরুঙ্গামারীর জয়মনির হাট এলএসডিতে চলতি ২০২৪-২৫ আমন মৌসুমে ৩৩টাকা কেজি দরে প্রতি মন ১৩২০ টাকা করে ১১শ ১১মেঃটঃ ধান সংগ্রহ করা হবে। ধান বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অত্র এলাকার কৃষকদের অনলাইনে রেজিষ্টেশন করতে হবে। যে কৃষক আগে রেজিষ্টেশন করবেন তাকে আগে অনুমোদন দেয়া হবে। অনুমোদন পরবর্তী ১৫দিনের মধে কৃষককে জয় মনিরহাট এলএসডিতে ধান বিক্রয় করতে হবে।

উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল জব্বার বলেন, এ বছর উপজেলায় আমন ধান চাষের লক্ষমাত্রা ছিলো ১৬ হাজার ৮৬০ হেক্টর, যেটা আমাদের অর্জিত হয়েছে। অলরেডি কর্তন শুরু হয়েছে প্রায় অর্ধেক (সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর) ধান কর্তন করা হয়েছে। আমাদের ফলন এবার সন্তোষজনক। অনুকূল পরিবেশ ছিল। রোগ, পোকা-মাকর তেমন ছিল না। মাঠে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ সার্বক্ষণিক কৃষকদের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে ডেলিভারি দেয়ার কারণে আমনের যে লক্ষমাত্রা সেটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। হাইব্রিড ৫.৭০ টন পার হেক্টর। উফশি ৪.৫ টন পার হেক্টরে পেয়েছি এতে কৃষকরা খুশি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

, , বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ