
মো. মনজুরুল ইসলাম, নাটোর: চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়ার দেশি মাছের শুটকির চাহিদা এখন সারাদেশে । চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শুটকির উৎপাদনও। চড়া দামেই এসব শুটকি বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের এক মাস বাকি থাকতেই গত বছরের তুলনায় এ বছর শুটকির উৎপাদন বেড়েছে ৯০ টন। একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে শুটকির উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন উৎপাদনকারীরা।
নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ধারে নিংগইন এলাকায় গড়ে উঠেছে চলনবিলের সর্বববৃহৎ শুটকি চাতাল। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই চাতালে কাজ করছেন ২৫ জন শ্রমিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কাটা, বাছাই, ধোয়া, রোদে শুকানো, তোলার কাজে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করেন।
শুটকি উৎপাদকরা জানান, প্রতি বছর ভরা বর্ষায় প্রচুর মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। হাঁটু পানিতে নেমেই এসব মাছ ধরা যায়। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। চলনবিলের চাহিদা মিটিয়ে মাছগুলো বাইরে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে কম দামে বিলের মাছগুলো কিনে বাইরের বাজারে চড় দামে বিক্রি করে।
নভেম্বর থেকে পানি কমতে শুরু করায় শুকিয়ে যেতে থাকে খাল ও বিলগুলো। তখন পলো বা হাত দিয়েই ধরা যায় টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, গজার, মাগুর, কই, চিংড়িসহ হরেক প্রজাতির দেশি মাছ। এসব মাছের কিছুটা বিক্রি হয় হাট-বাজারগুলোতে আর কিছুটা সরাসরি আসে শুটকি চাতালে।
সরেজমিনে নিংগইন শুটকি চাতালে গিয়ে দেখা যায়, নারী শ্রমিকরা বিলের তাজা টাকি মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ধোয়ার পর লবণ মাখিয়ে মাচায় মেলে দিচ্ছেন। সকালে রোদে দেয়া ভেজা মাছগুলোও এপিঠ-ওপিঠ উল্টে রাখছেন। পুরুষ শ্রমিকরা চাতাল ঘরে রাখা শুটকিগুলো আবারো রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। রাস্তার পাশে মাচার ওপর শুটকির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে অনেকেই কিনে নিচ্ছেন শুটকি।
বিক্রেতারা জানান, শৈল মাছের শুটকির কেজি আকারভেদে ৪০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত। পুঁটি ৩০০ টাকা, টাকি ৩৫০ টাকা, চেলা ৬০০ টাকা, চিংড়ি ৪০০থেকে ৮০০ টাকা, পাতাসি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, গুচি আকারভেদে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, কাঁচকি ৭০০ টাকা, বোয়াল ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, চাপিলা ৪০০ টাকা, মলা ৫০০ টাকা ও বাইম ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দেশি চিংড়ি মাছ খু্বই সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে তোলামাত্র তা বিক্রি হয়ে যায়। শুটকি তৈরির জন্য চাতালে এ মাছের চাহিদা বাড়ছে।
চলনবিল থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুটকি বিক্রি হয়। তবে সিংড়ার শুটকিগুলো চলে যায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে। এছাড়া রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্সবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখানে এসে শুটকি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। এখানকার শুটকি প্রস্তুতে লবণ ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করায় চাহিদা বাড়ছে দিনদিন।
শুটকি উৎপাদকরা মনে করেন, মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে বর্ষায় বিলের মাছ ধরে রেখে শীতের শুরুতে বা প্রয়োজনমাফিক শুটকি তৈরি করা সম্ভব। শুটকির মৌসুমে পর্যাপ্ত শুটকি থাকায় দাম বাড়ে না কিন্তু বছরের অন্য সময় চাহিদা বেশি থাকলেও সরবরাহ করা যায় না। সারা বছর শুটকি তৈরি সম্ভব হলে আশানুরূপ দামে সারা বছরই তা বিক্রি করা যাবে।
শুটকি ব্যবসায়ী জমির উদ্দীন বলেন, আমাদের শুটকির মান ভালো। বিক্রিও ভালো। কিন্তু সারাবছর আমরা শুটকি বিক্রি করতে পারতাম যদি একটা মাছ রাখার জায়গা থাকতো। দেশে শুটকির চাহিদা মেটাতে সিংড়ায় মৎস্য সংরক্ষণাগার তৈরি জরুরি।
কয়েকজন ক্রেতা জানান , চলনবিলের সুস্বাদু মাছের শুটকি পরিবারের জন্য লোভনীয়। সবাই পছন্দ করে। শুটকি মাছের তরকারি, ভর্তা খেতে মজা। এজন্য নিয়মিত চাতালে এসে শুটকি কিনতে আসেন। তবে বিলের মাছগুলো যদি সংরক্ষণ করা যেত বর্ষাকালে পানির দামে যেসব মাছ বিক্রি হয়, সেগুলো শীতকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারলে বৃহৎ এ মৎস্য সম্ভার প্রক্রিয়াজাত মাছ উৎপাদনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করত।