শনিবার, ১৪ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৮শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাম্পের বিজয় থামাবে যুদ্ধবাজ ইসরায়েলকে?

যায়যায়কাল ডেস্ক: ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসছেন। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন।

তার এ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক বিশ্লেষক মাইকেল মালুফ।

ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, সে বিষয়ে রুশ সংবাদ সংস্থা স্পুতনিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন মাইকেল মালুফ। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তানীতি বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করা মাইকেল মালুফ নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের স্বরাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে, সে বিষয়েও মতামত দিয়েছেন।

মালুফ বলেন, আমেরিকার জনগণ ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার মধ্যে একটি বার্তা আছে। তা হলো, তাঁরা বাইডেন-কমলা প্রশাসনের চার বছরের শাসনের পরিবর্তন চান।

পেন্টাগনের সাবেক এই বিশ্লেষক বলেন, মার্কিন জনগণের সামনে পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন তারা কেমন ছিলেন, আর বাইডেন-কমলা প্রশাসনের অধীন কেমন আছেন, তা তুলনা করে দেখার একটি সুযোগ এসেছিল। ট্রাম্পের ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাদের উদ্বেগ থাকলেও তার নীতিগুলো ছিল যথার্থ। সেই সব নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হয়েছিল।

মাইকেল মালুফ বলেন, ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ‘(ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের) সেই সব নীতিও নিশ্চিতভাবে বাস্তবায়ন করবেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর এসব নীতি বাস্তবায়নের জন্য তাঁকে অনেক কাজ দেওয়া হতে পারে।

ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের যুক্ততা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যয় কমানোর পথ দেখাবে বলে মনে করেন মাইকেল মালুফ।

তিনি বলেন, ‘মাস্ক ইতিমধ্যে বলেছেন, বছরে দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানোর সুযোগ তিনি দেখছেন। এটা একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমাদের বছরে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ডলার বাজেটঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় যদি দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ বাঁচানো যায়, তা আমাদের বাজেটঘাটতি কমাতে প্রকৃত অর্থেই সাহায্য করবে।’

মালুফ আরও বলেন, ‘সুতরাং আমরা সেরা কিছু দেখতে, আশা করতে যাচ্ছি। কিন্তু মার্কিন সরকারের আমলাতন্ত্রের কারণে এটাকে (মাস্কের ব্যয় কমানোর প্রস্তাব) বড় ধরনের বাধার মুখে পড়তে হবে।’

এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে অর্থনীতি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর শীর্ষে। বিশেষজ্ঞরা মূল্যস্ফীতি, বাড়ির দাম নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের ৩৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঋণের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোও সামনে এসেছে।

পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে: পেন্টাগনের সাবেক বিশ্লেষক মালুফ ইউক্রেন বিষয়ে বলেন, ‘আমার কাছে এটা স্পষ্ট, (ডোনাল্ড ট্রাম্প) আর জেলেনস্কি প্রশাসনকে অর্থ দিয়ে যেতে চান না। তিনি একটিও ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে নন। তিনি কোনো যুদ্ধই চান না। কারণ, তাঁর প্রথম মেয়াদে কোথাও যুদ্ধ ছিল না।’

ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্পের ‘নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে’ বলে মনে করেন মাইকেল মালুফ। তিনি বলেন, ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি (ন্যাটোর) সম্ভবত কাঠামো ঠিক রাখবেন। কিন্তু তিনি সদস্যদেশগুলোর ওপর নতুন শর্ত জুড়ে দিতে যাচ্ছেন এবং তাদের দায়দায়িত্বও আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করবেন।’

মাইকেল মালুফ বলেন, ‘ন্যাটোকে বর্তমানে আমরা যতটা না প্রতিরক্ষামূলক, তার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক জোটের ভূমিকায় দেখছি। আমার মনে হয়, তিনি এ প্রবণতায় লাগাম টানতে চান। কারণ, ন্যাটো আক্রমণাত্মক হওয়ার কারণেই আমরা ইউক্রেনে এই গোলমেলে অবস্থায় পড়েছি।’

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ৬১ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিরাপত্তাসহায়তা দিয়েছে। ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে গিয়ে পেন্টাগনের নিজের অস্ত্রভান্ডারে টান পড়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে কিয়েভের জন্য ওয়াশিংটনের সহায়তা প্যাকেজগুলো পরিমাণে ছোট হয়ে এসেছে। রাশিয়া বারবার ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক সহায়তার বিষয়ে সতর্ক করেছে। মস্কো বারবার বলেছে, এর মধ্য দিয়ে শুধু সংকট দীর্ঘায়িত হবে।

মধ্যপ্রাচ্য: প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তিনি ইসরায়েলের বিষয়ে গতবারের বিপরীত নীতি গ্রহণ করতে পারেন বলে মনে করেন মাইকেল মালুফ। তিনি বলেন, ট্রাম্প (গাজা ও লেবাননে) যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে (ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন) নেতানিয়াহুর সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

মালুফ বলেন, ‘(ট্রাম্প) সম্প্রতি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, এসব শেষ করেন। লড়াই বন্ধ করেন এবং শর্তে আসুন। তিনি (নেতানিয়াহু) যদি তা না করেন, তাহলে আমি মনে করি, তিনি (ট্রাম্প) ভিন্নভাবে বিষয়টি নিয়ে এগোবেন। যদিও প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর চাওয়ার প্রতি খুবই আন্তরিক ছিলেন। ইসরায়েল যা কিছু চেয়েছিল, তার সবকিছু তিনি তাদের দিয়েছিলেন।’

মাইকেল মালুফ আরও বলেন, ট্রাম্প সৌদি আরবের দিকে আরও এগোবেন। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও আব্রাহাম চুক্তি পুনরায় সচল করার জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে।

মালুফ মনে করেন, এসব কিছুর অর্থ হলো পররাষ্ট্রনীতি উল্টো দিকে যেতে চলেছে। এর অর্থ হলো, ইসরায়েল যা কিছু চায়, সে বিষয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হবে। বরং উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর চাওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যুদ্ধের ক্ষতি’ প্রকল্পের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিতে গিয়ে রেকর্ড ১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নীতি কী হবে: মাইকেল মালুফ মনে করেন, ট্রাম্প উত্তেজনা কমানোর জন্য উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় সচল করার চেষ্টা করবেন। এর মাধ্যমে উত্তর কোরীয় নেতাকে (ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা থেকে) বিরত রাখতে চেষ্টা করবেন।

মালুফ জোর দিয়ে বলেন, ‘ট্রাম্পের বিগত প্রশাসনের আমলে আন্তর্জাতিক মহল কোরীয় উপদ্বীপকে অস্ত্রমুক্ত করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়াকে উত্তর কোরিয়া উসকানি হিসেবে দেখে। তাই আমি মনে করি, আপনাকে এমন কিছু করতে হবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার সব ধরনের সামরিক মহড়া বন্ধ হয়। দেশ দুটির মধ্যে এ ধরনের যৌথ মহড়া কমে এলে আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। আমার মনে হয়, চীনও এটাকে স্বাগত জানাবে।’

ট্রাম্প এমন এক সময়ে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিকায়ন ঘটছে। ২০২১ সালে এ অঞ্চলে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে অকাস (এইউকেইউএস) সামরিক জোটের সূচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মস্কো মনে করে, এ ধরনের সামরিকায়নের ‘একটি স্পষ্ট লক্ষ্য হলো ওই অঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার স্বার্থকে সীমিত করা’।

ন্যাটোর জন্য কী অপেক্ষা করছে: মাইকেল মালুফ মনে করেন, ট্রাম্প ন্যাটোর সদস্যদের বিষয়ে অনেক বেশি কঠোর হবেন। তিনি চাইবেন, সদস্যদেশগুলো যেন ন্যাটোতে নিজেদের ভাগের অংশ বাড়ায়, আর তা না হলে যেন জোট থেকে বেরিয়ে যায়।

পেন্টাগনের সাবেক এই বিশ্লেষক মনে করেন, ন্যাটো ইউক্রেনের বিষয়ে যেমনটা আক্রমণাত্মক হয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে কম আগ্রাসী হয়, সে চেষ্টা ট্রাম্প করবেন। কারণ, (ইউক্রেন যুদ্ধ) ইউরোপের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। ইউরোপীয়রা এখন বুঝতে পারছে যে (ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে) তাদের মূল্য গুনতে হচ্ছে। তাদের এই পথে পরিচালিত করার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছে।

মালুফ মনে করেন, ট্রাম্প ন্যাটোর বরাদ্দ কমাতে শুরু করবেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কালে জোটটিতে খুব সম্ভবত ফাটল ধরবে। প্রকৃতিগতভাবে জোটটি অনেক বেশি আঞ্চলিক হয়ে পড়তে পারে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক এই বিশ্লেষকের শেষ কথা হলো, ন্যাটোকে বাঁচিয়ে রাখা ও বিকাশের বিষয়ে বাইডেন-কমলা প্রশাসনের তুলনায় (ট্রাম্প প্রশাসন) কম উৎসাহ দেবে।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে ন্যাটোভুক্ত করার বিষয়ে মস্কো সব সময় হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছে। কারণ, এতে ইউরোপে উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে মনে করে ক্রেমলিন। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে জোটভুক্ত করা হবে না বলে ১৯৯১ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ন্যাটো। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি না রাখায় ন্যাটোর কঠোর সমালোচনা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *