
পাভেল ইসলাম মিমুল, উত্তরবঙ্গ: ২০২২-২৩ অর্থবছরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মেগা প্রকল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম”ভারতের সাথে রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চিলাহাটি এবং চিলাহাটি বর্ডারের মধ্যে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ” অর্থাৎ চিলাহাটি ব্রডগেজ রেল প্রকল্প।
প্রকল্পের বিল তুলে নিয়ে ৫ আগষ্ট-২৪ থেকে পলাতক রয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্যাসেল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এর স্বত্বাধিকারি যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা
কাজী নাবিল।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে “সরকার ঘনিষ্ঠ” বলে পরিচিত ঐ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আব্দুর রহিম। তিনি প্রকল্প চলাকালীন সময় বাংলাদেশ রেলওয়ে পাকশী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিইএন-২) ছিলেন। পরে হন ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ার। প্রকল্প নিয়ে রেল অঙ্গনে সমালোচনার মুখে তাকে পশ্চিম রেল থেকে পূর্ব রেল অর্থাৎ চট্টগ্রামে বদলী করা হয়। তবে এত কিছুর পরেও তিনি বহাল তবিয়তে দিব্যি চড়ে বেড়াচ্ছেন প্রকল্পের টাকায় কেনা জাপানী মিতসুবিশি কোম্পানীর পাজেরো স্পোর্স মডেলের ৭৫ লাখ টাকার গাড়ী !
জানা যায়,ঐ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল জুন-২৩ এ ৷ তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ১ম সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে সেটি জুন-২৪ এ শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। যদিও ঐ প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি।প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) বলেছেন “আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে ঠিকাদার যদি সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে না পারেন সে ক্ষেত্রে জিআইবিআরের সুপারিশ অনুযায়ী পানিশমেন্ট দিয়ে বিদায় করা হবে।”
প্রশ্ন আসছে,যে প্রতিষ্ঠান কাজটি পেয়েছে অর্থাৎ ক্যাসেল কনস্ট্রাকশন,তাদের কি কোন কার্যক্রম চালু আছে ? প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজী নাবিল গা ঢাকা দিয়েছেন ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট থেকেই।
সূত্র বলছে,কাজের মেয়াদ ও কাজ শেষ না করেই পিডি’র প্রত্যক্ষ মদদে প্রকল্প ব্যয়ের নব্বই ভাগ বিল তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।বর্তমানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক সহ উর্ধতনরা সকলেই পলাতক। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে সরকারের পরিবহন অডিট অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে তারা বলছেন,পিপিআর ২০০৮ বিধি ৩৯(১৫) এবং বিধি ৩৯(১৬) অনুযায়ী প্রকল্প ব্যবস্থাপক এই দুই বিধি লঙ্ঘন করেছেন। কাজ চলমান থাকা সত্ত্বেও কাজ শেষ দেখানোর ঘটনায় সরকারের এই বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
পিডি আব্দুর রহিম’কে তার সরকারি ও ব্যক্তিগত উভয় নম্বরে চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি;তবে অন্য একটি জাতীয় পত্রিকাকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের কাজ শেষ না হতেই বিল পরিশোধসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে আব্দুর রহিম বলেছেন, ‘এ বিষয়ে ওনারা (পরিবহন অডিট অধিদপ্তর) ভালো জানেন। লেখার কথা লিখছেন। এ বিষয়ে আমাদের যেভাবে জবাব দেওয়ার কথা সেভাবে জবাব দিয়েছি। মূল কথা হচ্ছে,টাকা ঠিকাদারকে দেওয়া হয়নি। অর্থবছর শেষ হয়ে যাচ্ছিল তা-ই পরিমাণমতো টাকা আমাদের হিসাব খাতে রেখে দিয়েছি।পরে যখন ঠিকাদার এই কাজগুলো শেষ করেছেন তখন আমরা কাজের মূল্য অনুযায়ী সেই স্থগিত করা টাকা থেকে অর্থ পরিশোধ (ছাড়) করেছি। কারণ কাজ না করে আগেই যদি পরিশোধ করে দিই সে ক্ষেত্রে ঠিকাদার পালিয়ে যাবেন। কারণ এখন পালিয়ে যাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা চলছে। তাই আমাদের হাতে টাকা রেখে আস্তে আস্তে পরিশোধ করেছি। এখন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে ঠিকাদার যদি সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে না পারেন সে ক্ষেত্রে জিআইবিআরের সুপারিশ অনুযায়ী পানিশমেন্ট দিয়ে বিদায় করা হবে।’
পিডির বক্তব্য অনুযায়ী “জিআইবিআরের সুপারিশ অনুযায়ী পানিশমেন্ট দিয়ে বিদায় করা হবে।” তাহলে প্রশ্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তো আগেই বিদায় হয়েছে,কাগজে কলমে বিদায় দিলে কি সরকারের এই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে ? প্রকল্পের কাজ কে শেষ করবে ? যদি ফেরত পাওয়া যায় তাহলে সরকারি কোষাগারের তসরুপ হওয়া এতগুলো টাকা কি জলে গেল ? জলে গেলে দায় কার ? ঠিকাদারের ? বিগত সরকারের বা বর্তমান সরকারের, নাকি ঐ কাজ সংশ্লিষ্ট রেলের কর্মকর্তাদের ?
কাজ সংশ্লিষ্ট কারা ? প্রথমত পিডি,এরপর ঠিকাদার, রয়েছেন রেলের অর্থ ছাড়কারি কর্তৃপক্ষ,যারা সাব হিসেবে সরবারাহের কাজ নিয়ে সরবরাহ না করে টাকা তুলে নিয়েছেন, প্রকল্পের সাইট ইঞ্জিনিয়ার যিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে চড়ে বেড়াচ্ছেন ৩০ লাখ টাকার গাড়ী, করেছেন বিভাগীয় শহরে আলীশান বাড়ী,বদলে ফেলেছেন গ্রামের বাড়ীর পুরনো রুপ ; একজন অফিস সহকারি যিনি কর্মসূত্রে থাকা এলাকায় কিনেছেন এক দাগে পাঁচ বিঘা জমি…।
এদিকে প্রকল্পের কাজ নিয়ম অনুযায়ী মান নিশ্চিত করে যথাসময়ে শেষ হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে গত মার্চ মাসে দেওয়া প্রতিবেদনে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) বর্তমানে জিএম (পশ্চিম রেল) ফরিদ আহমেদ প্রকল্পের ‘প্যাকেজ নম্বর ডব্লিউডি-২’ সম্পর্কে তার অসন্তোষ জানিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন,ওয়াশ পিটের ওপর রেললাইন বসানো হয়নি। তা ছাড়া ওয়াশ পিটের সোক ওয়েলের ফিনিশিং কাজ সন্তোষজনক নয়। পাশাপাশি ওয়াশ পিটের জয়েন্ট কলামে কনস্ট্রাকশন জয়েন্টে ক্র্যাক পরিলক্ষিত হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদের শেষ সময়েও নির্ধারিত কাজগুলো সমাপ্ত হয়নি। জিআইবিআর ফরিদ আহমেদ প্রকল্পের বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই করতে পরিদর্শন শেষে রেল গত ১১ মার্চে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ফরিদ আহমেদ ‘প্যাকেজ নম্বর: ডব্লিউডি-২-এর অধীনে প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ, প্ল্যাটফর্ম শেড, নতুন ফুট ওভারব্রিজ, প্ল্যাটফর্ম উঁচুকরণ, পানি সরবরাহব্যবস্থা এবং ইলেকট্রিক্যাল কাজসহ ওয়াশ পিট নির্মাণ,পানি নিষ্কাশন সুবিধাসংক্রান্ত কাজ চলমান রয়েছে। ওয়াশ পিটের ওপর রেললাইন বসানো হয়নি, ওয়াশ পিটের সোক ওয়েলের ফিনিশিং কাজের মান সন্তোষজনক নয়। তা ছাড়া ওয়াশ পিটের জয়েন্ট কলামে কনস্ট্রাকশন জয়েন্টে ক্র্যাক পাওয়া গেছে। তিনি তার পরিদর্শন প্রতিবেদনে ডিপিপি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অর্থ দণ্ড দেওয়ার সুপারিশও করেছেন।
এ সব বিষয়ে পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম-রাজশাহী ) ফরিদ আহমেদ’র কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদনের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “প্রতিবেদন জমা দিয়েছি,ব্যবস্থা নেবেন কর্তৃপক্ষ”।
পুরো ঘটনার বিস্তারিত জানতে এবং জানাতে চিলাহাটি প্রকল্প স্থল,সংশ্লিষ্ট দপ্তর পাকশী, সৈয়দপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী,প্রকল্প পরিচালক এবং ঢাকা কমলাপুরে অবস্থিত ঐ প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ের নথিপত্র সংগ্রহের কাজ করছে দৈনিক সকালের সময় ও দৈনিক যায়যায় কাল সংগ্রহের কাজ শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই পাঠকের সামনে আসছে বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের সাথে যোগসাজশে কারা কারা এই লুটপাটের অংশীদার ?