বিশেষ প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ : আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ বাংলার হস্তশিল্প কারুকাজ সম্পন্ন ঐতিহ্যবাহী মোড়া প্রায় বিলুপ্তির পথে। অতীতে গ্রাম-বাংলার ধনী-গরিব সকল শ্রেণি পেশাজীবি মানুষের বাসাবাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসার আসন মোড়ার ব্যবহার হলেও বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ হস্তশিল্পের পাশাপাশি বাঁশ, বেত ও প্লাস্টিক নকশার আদলে তৈরিকৃত মোড়া তৈরির কারিগররাও হারিয়ে যাচ্ছে।
এক সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে হস্তশিল্প হিসেবে সাংসারিক কাজেকর্মে ব্যবহার যোগ্য নানা ধরনের বাঁশ ও বেত সামগ্রী তৈরীর কাজ করা হতো। কালের বিবর্তণে এসব হস্তসামগ্রী তৈরির দৃশ্য তেমন আর চোখে পড়ে না।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামের এক শ্রেণীর মানুষ বাঁশ ও দড়ি দিয়ে তৈরী করা মোড়া বিক্রি করে জীবিকা নির্ভর করতেন।
বিশেষ করে জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নের আটঘরিয়া, দরবস্ত, জয়ানপুর, ভিকমপুর, চান্দাইকোনা ইউনিয়নের খোকশাহাট, সোনাখাড়া ইউনিয়নের নিমগাছী ও পাঙ্গাসী, নলকা, ধুবিল, ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামের শত শত বসবাসকারী পরিবার বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরীর মাধ্যমে হস্তশিল্প তৈরী ও তা হাটে বিক্রি করে সংসার চালাত।
পরিবাররের নারী ও পুরুষ সদস্যরা মোড়া, দাড়ি পালা, ঢোলাসহ নানা সামগ্রী তৈরী করছিলেন। বিভিন্ন হাটবাজারে বাঁশের শলাকা, বেত ও প্লাস্টিকের ফিতার আবরণে তৈরী প্রতিটি মোড়া আকার ভেদে বিক্রি করা হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা করে। এছাড়া মাঝে মধ্যে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করেও ঐতিহ্যবাহী এসব মোড়া ও হস্তশিল্পের নানা ধরনের সামগ্রী বিক্রি করতে দেখা যায় না।
ধুনুট উপজেলার বগা জোলাগাতী গ্রামের বাসিন্দা শুভ কুমার দাস (২০) হঠাৎ রায়গঞ্জ উপজেলা চত্বরে মোড়া বিক্রি করতে দেখা যায় তাকে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, আধুনিক প্লাস্টিক ও স্টিলের চেয়ারের যুগে ঐতিহ্যবাহী মোড়া তলানিতে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা ছোট বেলায় দেখেছি বাড়ীতে অতিথি এলে মোড়াতে বসতে দেয়া হতো। কিন্তু এখন গ্রামেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তাই আগের মত মোড়ার ব্যবহার নেই। বাপ দাদার পেশা ছিল এই মোড়া তৈরি করে তা বিক্রি করে সংসার চালানো। বাবা মারা যাওয়ার পর মা, ভাই বোন ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার সংসার।বাব দাদার রেখে যাওয়া এই পেশাকে ধরেই বর্তমানে চলছে তার সংসারের হাল। প্রতিটি মোড়া বিক্রি করেন ১৫০-২০০ টাকা দরে। দিনে ১ হাজার থেকে প্রায় দেড় হাজার টাকার বেচা বিক্রি হয়। এতে অন্তত ৩০০-৬০০ টাকা রোজগা হয়। আর তা দিয়েই চলে তাদের সংসার।
পাঙ্গাসী এলাকার মফিজ উদ্দিন বলেন, এক সময় মোড়ার জন্য পাইকাররা বাড়ীতে এসে অর্ডার দিতো। দিন রাত সমান তালে পরিবারের সবাইকে কাজ করতে হতো। এ কাজে বিভিন্ন উপকরণ সামগ্রীর দাম অনেকাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরীতে প্রভাব পরেছে। বিক্রি করে ন্যার্য মূল্য পাওয়া যাচ্ছেনা। বাধ্য হয়েই জীবন জীবিকার জন্য এ পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় গেছে অনেকে।
বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, গ্রামীণ জনপদে বাঁশ ছিল একটি ঐতিহ্য। প্রতি বাড়িতে কমবেশি চাষ হতো বাঁশ। যা দিয়ে তৈরি হতো নিত্যদিনের গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত সকল ধরনের জিনিসপত্র। তবে এখনো মাঝেমধ্যে গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, বাইর, পাতি, খাচা, উন্যা চোখে পড়ে। উপজেলার প্রতিটি গ্রামে কম বেশি অনেক পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে তারা তৈরি করত গৃহস্থালি ও সৌখিন নানা পণ্যসামগ্রী। তা দেখতে অনেকটা আকর্ষণীয় ছিল। এসব বিক্রি করেই চলত গ্রামগঞ্জের এসব মানুষের জীবনযাপন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঁশের দাম বৃদ্ধি, খরচের তুলনায় লাভ কম ও দিনদিন চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র এ শিল্পের কারিগরদের অধিকাংশই এখন আদি পেশা বদল করে কৃষিসহ নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন।