মঙ্গলবার, ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু: একজন ঠান্ডা মাথার গণহত্যাকারী

যায়যায়কাল ডেস্ক: নিজের ফাঁদেই যেন ধরা পড়লেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। চেয়েছিলেন আলোচনার সব পথ বন্ধ করে দিতে। সে জন্য সব চেষ্টাই করেছিলেন তিনি।

একজন যুদ্ধবাজ নেতার কাছে আলোচনা শুধু সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসরায়েলি নেতার এমন মনোভাব বুঝতে বিশ্ববাসীর খুব একটা সময় লাগেনি। কিন্তু, যারা দেশ চালান বা দেশের হর্তাকর্তা তারাই যেন বুঝতে পারেন না।

জনমতের চাপে বাধ্য হয়েই বিশ্বনেতারা যখন ক্রমাগত নেতানিয়াহুকে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি তথা শান্তির পথে আসতে বলছেন, তখন তিনি বাড়িয়ে দেন যুদ্ধের মাত্রা। গাজাবাসীর ওপর চালিয়ে যান গণহত্যা। চাপিয়ে দেন দুর্ভিক্ষ।

শুধু তাই নয়, যুদ্ধের পরিধি বেড়ে যায় বহুগুণ। ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর হয়ে তা গিয়ে ঠেকে পারস্য উপসাগরে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যেন ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ হয়ে পড়েন নেতানিয়াহু। হামাস ও হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যার পর তিনি আরও বেশি বেপরোয়া হন। শীর্ষ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে হামলা চালান নিজ দেশ থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ ইরানে।

তাতেও যেন তৃপ্ত নন নেতানিয়াহু। নিজ দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবি উপেক্ষা করে তিনি ক্রমশ আলোচনার পথ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। বারবার ভেস্তে যাওয়া আলোচনার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন—যুদ্ধই তার শেষ কথা। তিনি শেষ পর্যন্ত তথা তার পরিপূর্ণ বিজয় না হাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। তাই বন্ধ রাখতে চান আলোচনার সব পথ। শুধু বন্ধই নয় চিরতরে বন্ধের আশায় গত ৯ সেপ্টেম্বর চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে বসেন।

সেদিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে গাজা যুদ্ধ বন্ধের মধ্যস্থতাকারী কাতারের রাজধানী দোহায় প্রতিপক্ষ হামাসের আলোচনাকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। সে কথা সদর্পে স্বীকারও করেন তিনি। কিন্তু, বিধি বাম! ব্যর্থ হয় সেই হামলা। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ন্যাক্কারজনক উদাসীনতা দেখিয়ে তিনি বিনা উসকানিতে অন্য দেশে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও নিজের মুখ বাঁচাতে পারেননি।

নেতানিয়াহুর দোহা হামলা তার নিজের জন্যই যেন খুলে দিয়েছে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের নতুন এক দরজা। সেই হামলার ২০ দিন পর বিশ্ববাসী দেখেছে এক নতুন বাস্তবতা। কোনো প্রকাশ্য পূর্বালোচনা ছাড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি ২০ দফা পরিকল্পনা চাপিয়ে দেন নেতানিয়াহুর ওপর। মার্কিন মুলুকে দাঁড়িয়ে তিনি সেই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেও নিজ দেশের জনগণের কাছে চেষ্টা করছেন ভিন্ন বার্তা দেওয়ার।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবে নেতানিয়াহু রাজি হলেও তা ভবিষ্যতে তার জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় ঢেকে আনতে পারে। কেননা, শান্তি-বিরোধী এই ব্যক্তি যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়েই ক্ষমতায় টিকে আছেন। সেই যুদ্ধই যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে একাধিক অভিযোগে। এর মধ্যে আছে দুর্নীতির অভিযোগও।

যেভাবে এলো ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাব

গত ৩ অক্টোবর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—’যেভাবে ইসরায়েলের কাতার হামলার ক্রোধ নেতানিয়াহুকে গাজা প্রস্তাব মানতে বাধ্য করেছে’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নেতানিয়াহুর সব আগ্রাসী কর্মকাণ্ডকে ছাড়িয়ে গেছে কাতার হামলা। দোহা আলোচনায় একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে বানচাল করার জন্য ইসরায়েলের কাতার হামলা সব আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক মিত্রসহ ওয়াশিংটনকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছে।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! কাতার হামলার ২০ দিন পর হোয়াইট হাউসে মিত্র ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ‘যুদ্ধের লক্ষ্যগুলো মেটানো হয়েছে’ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাম্প এই প্রস্তাবকে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করলেও নেতানিয়াহুর মুখে সেই প্রস্তাব নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যাচ্ছে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাতারে ইসরায়েলের হামলা লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলেও তা ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টাদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। তারা নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করার ব্যবস্থা নেন। যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নেতানিয়াহু সব আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যান। তার ঔদ্ধত্য আচরণ এমন পর্যায়ে যায় যে তা বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে ইসরায়েলকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

তবুও যুক্তরাষ্ট্র অকাতরে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে যায় ইসরায়েলকে। তবে কাতারে আচমকা হামলা যে নেতানিয়াহুর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে তা হয়ত তিনি ভাবতেও পারেননি।

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত শুক্রবার হামাস ট্রাম্পের প্রস্তাব মোতাবেক জিম্মি বিনিময়ে ‘রাজি’ বলার পর ঘটনাটি নাটকীয় রূপ নেয়। জন্ম দেয় নতুন প্রশ্নের। হামাসের এমন ইতিবাচক সাড়া কি ইসরায়েল ও হোয়াইট হাউসকে সন্তুষ্ট করতে পারবে? যা হোক, যে ব্যক্তি যেকোনো শান্তি আলোচনা বা প্রস্তাবকে ভেস্তে দিতে ওস্তাদ সেই ব্যক্তিকেই মেনে নিতে হলো এমন একটি শান্তি প্রস্তাব, যা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে মুসলিম ও আরব নেতারাও সম্মতি দিয়েছেন।

ইসরায়েলের পছন্দের মানুষ তথা ট্রাম্পের জামাতা ও সাবেক মধ্যপ্রাচ্য মধ্যস্থতাকারী জারেড কুশনারকে ডেকে আনা হয় শান্তি প্রক্রিয়াটিকে চাঙা করার জন্য। এর অংশ হিসেবে নেতানিয়াহুকে অবমাননাকর ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।

মার্কিন আইনজীবী, আবাসন ব্যবসায়ী ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি ও শান্তিদূত স্টিভ উইটকফ কাতারে ইসরায়েলি হামলায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। হামলার পর তিনি কাতার ও অন্যান্য আরব দেশে ফোন দিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল না। কিন্তু, ততক্ষণে এক গুরুত্বপূর্ণ আরব মিত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ সারাবিশ্বে প্রচার হয়ে গেছে।

কাতার গাজা যুদ্ধ বন্ধের মধ্যস্থতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। বন্ধ হয়ে যায় শান্তি আলোচনা। সার্বিক পরিস্থিতিকে বিশেষ করে, কাতারে ইসরায়েলের ব্যর্থ হামলাকে বিশেষ ও অপ্রত্যাশিত সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসন। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাকে শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে বাধ্য করেন।

এভাবেই যে শান্তি আলোচনাকে নেতানিয়াহু সবসময় বিরোধিতা করে আসছিলেন, নিজের ভুলে তাই তাকে মেনে নিতে হলো।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক নেড লাজারাস দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এই শান্তি প্রস্তাব কার্যকর কিনা তার চেয়ে বড় কথা এটি আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে একত্রিত করেছে। এই প্রস্তাবে ইসরায়েলেরও সায় আছে। বলা যেতে পারে, সম্ভবত এটিই এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে সফল কূটনৈতিক কার্যক্রম।’

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ