
যায়যায়কাল ডেস্ক: তিব্বতের লুনজে বিমানঘাঁটিতে চীন ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার, নতুন প্রশাসনিক ব্লক এবং একটি নতুন অ্যাপ্রন নির্মাণ করেছে।
এই ঘাঁটিটি অরুণাচল প্রদেশের ভারত ও চীন সীমান্তের ম্যাকমোহন লাইন থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
অরুণাচল প্রদেশের কৌশলগত শহর তাওয়াং থেকে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার দূরে লুনজে ঘাঁটিতে নতুন বিমান বাংকার নির্মাণের ফলে চীন এখন তাদের যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন সিস্টেমকে আরও সামনে মোতায়েন করার সুযোগ পাবে। এতে অরুণাচল প্রদেশ ও আসামে অবস্থিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) ঘাঁটি থেকে আকাশপথে যেকোনো হুমকির দ্রুত জবাব দিতে সক্ষম হবে চীন।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) সাবেক প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বি এস ধানোয়া এনডিটিভিকে বলেন, লুনজেতে ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার নির্মাণ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে কোনো ঘটনা ঘটলে তাদের কৌশলগত ফাইটার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার লুনজে ঘাঁটি থেকেই তাদের সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেবে।
ধানোয়া আরও বলেন, এ এলাকার ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলোতে সম্ভবত ইতিমধ্যেই গোলাবারুদ ও জ্বালানি মজুত করে রাখা হয়েছে।
ভারতের সাবেক এই বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালে ডোকলাম ঘটনার সময় আমার কর্মীদের বলেছিলাম, তিব্বতে পিএলএএএফের (পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ারফোর্স) সমস্যা বিমান নয়, সমস্যা হলো মোতায়েন। তখন আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তারা তিব্বতের বিমানঘাঁটিগুলোতে মজবুত বিমান বাংকার তৈরি শুরু করার অর্থ হবে তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিব্বতে তাদের মূল দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে।’
ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান এয়ার মার্শাল অনিল খোসলা বলেন, এসব বিমানঘাঁটির নির্মাণ ও আধুনিকীকরণ চীনের ভবিষ্যতের যুদ্ধ পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি ভারতের জন্য ‘গুরুতর কৌশলগত হুমকি’। বিশেষত, ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, চীনের সামরিক সক্ষমতার বিকাশ এবং অবকাঠামো তৈরির ধরন বিশ্লেষণ করলে এই ঝুঁকি স্পষ্ট।
অনিল খোসলা বলেন, ‘লুনজেতে চীনের এই আধুনিকীকরণ আঞ্চলিক নিরাপত্তায় গভীর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ২০২০ সাল থেকে ভারত ও চীন সীমান্তে অচলাবস্থা চলছে। ৩৬টি মজবুত বিমান বাংকার তাদের সরঞ্জামগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখতে, কেন্দ্রীভূত আক্রমণের ঝুঁকি কমাতে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী অপারেশন চালানোর সুবিধা দেবে।’
এয়ার মার্শাল খোসলা বলেন, মজবুত বিমান বাংকারগুলো নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদী গোলাবারুদ, ভারতীয় বিমান হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে সুরক্ষা দেবে, যার ফলে ‘সংঘর্ষের শুরুতে ঘাঁটিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা অনেক বেশি কঠিন হবে।
বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, টিংরি, লুনজে ও বুরংয়ের মতো বিমানঘাঁটিগুলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) খুব কাছে, ৫০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এত কাছে থাকার কারণে পিএলএ বিমানবাহিনীর সরঞ্জামগুলো সামনের অবস্থানে দ্রুত মোতায়েন এবং সীমান্তে কোনো উত্তেজনা দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে সাড়া দিতে পারবে। এসব বিমানক্ষেত্র অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, উত্তরাখন্ড ও লাদাখে ভারতীয় অবস্থানকে নিশানায় আনতে সক্ষম হবে।
চীন তাদের সিএইচ–৪ মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি) ব্যবহার করছে, যা ১৬ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা থেকে স্বল্পপাল্লার আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর থাকার কারণে সিএইচ–৪ ড্রোনটিকে তিব্বতের অনেক উচ্চতার অঞ্চলে হামলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের দিকে সবচেয়ে সরাসরি জবাব ২০২৯ সালে আসা শুরু করবে, যখন আইএএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহরে জেনারেল অ্যাটমিক্স-নির্মিত স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন যুক্ত হবে। দুটি বাহিনীর প্রতিটি আটটি করে ড্রোন পাবে। স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন, যার ১৫টি ভ্যারিয়েন্ট ভারতীয় নৌবাহিনীও কিনছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত ড্রোনগুলো হিমালয় অঞ্চলজুড়ে ভারতের গোয়েন্দা ও নজরদারি সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানার সুবিধা দেবে। বর্তমানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম ইসরায়েলের নির্মিত হেরন এবং সার্চার ইউএভি ব্যবহার করছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান এয়ার মার্শাল এসপি ধারকর বলেন, চীনের মজবুত বিমান বাংকার নির্মাণ ভারতের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হবে।
ধারকার বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের উত্তরের সীমান্তজুড়ে নানা ঘটনাপ্রবাহ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করি। ঐতিহাসিকভাবে, আমরা এই বিষয়টি ভেবে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম, সেই অঞ্চলের ভূগোল, ভূখণ্ড এবং উচ্চতা বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সুবিধা দিত। আমরা এখন দেখছি, চীনের আধুনিক ও আরও সক্ষম প্ল্যাটফর্ম তৈরি এবং বৃহত্তর অবকাঠামো ও লম্বা রানওয়েসহ আরও বেশি বিমানক্ষেত্র তৈরির ফলে আমাদের সেই সুবিধা কিছুটা সংকুচিত হচ্ছে।’
ভূ-গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ড্যামিয়েন সাইমন বলেন, ভারতের তাওয়াং সেক্টরের বিপরীতে এই বিমান বাংকারগুলোর দ্রুত নির্মাণ ঐতিহাসিক স্পর্শকাতর অঞ্চলে চীনের বিমানশক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
সাইমন বলেন, ভারত এলএসির এই অংশে শক্তিশালী বিমান অবকাঠামো বজায় রাখলেও লুনজেতে চীনের সামরিকীকরণের মাত্রা বেইজিংয়ের সেই ব্যবধান কমিয়ে আনার পরিকল্পনাকে তুলে ধরছে।
লুনজে ঘাঁটির এই আধুনিকায়ন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন চীন হিমালয় সীমান্ত বরাবর ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আরও ছয়টি নতুন বিমানঘাঁটির আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এ বছরের এপ্রিলে এনডিটিভি স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছিল, যাতে চীনের টিংরি, লুনজে, বুরং, ইয়ুটিয়ান এবং ইয়ারকান্তের ঘাঁটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। হ্যাঙ্গার ও রানওয়ের সম্প্রসারণ ছাড়াও বিমানঘাঁটিগুলোতে নতুন অ্যাপ্রন স্পেস, ইঞ্জিন পরীক্ষার প্যাড এবং সহায়তা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
গত এপ্রিলে চীনের বিমানক্ষেত্র নির্মাণের ছবি পর্যালোচনা করার পর ভারতীয় বিমানবাহিনী এনডিটিভিকে এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘আমাদের প্রক্রিয়া চালু আছে এবং আমরা বিষয়গুলো নজরে রাখছি।’
চীনের বিদ্যমান বিমানঘাঁটিগুলোর অব্যাহত আধুনিকায়ন এবং নতুন ঘাঁটি নির্মাণ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বহু দশক ধরে হিমালয় বরাবর ভারতীয় বিমানবাহিনীর উত্তর দিকে লেহ থেকে পূর্বে চাবুয়া পর্যন্ত ১৫টি প্রধান বিমানঘাঁটির মোকাবিলায় বেইজিং এসব কিছু নির্মাণ করছে।
২০২০ সালের ১৫ ও ১৬ জুন ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে গালওয়ানে সংঘর্ষের পর দুই দেশের সম্পর্কে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পরে বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারত ও চীন বিমানঘাঁটি আধুনিকায়ন করছে। দুই দেশের এসব উদ্যোগ এই অঞ্চলে একটি নতুন কৌশলগত বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করছে।












