বৃহস্পতিবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসরায়েলকে যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

যায়যায়কাল ডেস্ক: লেবাননে টানা কয়েক দিন বিমান থেকে নির্বিচার বোমা হামলার পর দেশটিতে ঢুকেছে ইসরায়েলের সেনারা। এই সামরিক আগ্রাসনে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

মঙ্গলবার ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে ঢোকার পর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এতে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা থেকে পিছু হটার অনুরোধও আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলছে অন্য কথা। সীমিত পরিসরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে সেনা অভিযান চালানোকে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে বর্ণনা করেছে ওয়াশিংটন।

সোমবার মধ্যরাত থেকে ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে ঢুকতে শুরু করে। ইসরায়েল যে লেবাননে স্থলপথে হামলা শুরু করতে যাচ্ছে, কয়েক দিন ধরেই অবশ্য এই গুঞ্জন চলছিল। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট কিছু স্থান ও লক্ষ্যবস্তুতে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযান’ চালাবে তারা।

তবে লেবাননে ইসরায়েলি সেনারা ঢোকার পর ইরান–সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তো রয়েছেই, পাশাপাশি এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই ইসরায়েলের সেনারা লেবানের ঢোকার পরপরই এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কাতার ও জাপান।

এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। গ্যালান্টকে তিনি জানিয়েছেন, লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে হিজবুল্লাহকে তাড়িয়ে দিতে ইসরায়েল যে স্থল আক্রমণ শুরু করেছে তাতে সম্মতি আছে ওয়াশিংটনের।

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটা স্পষ্ট করেই বলেছি, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।’ এদিকে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে একই ধরনের অবস্থানের কথা জানিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে লেবাননে ইসরায়েলের সীমিত পরিসরে স্থল হামলার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিবৃতিতে এ–ও বলা হয়েছে যে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়া দেশটির অন্যত্র স্থল হামলার বিপক্ষে হোয়াইট হাউস। লেবানন সীমান্তে স্থিতিশীলতা একমাত্র কূটনৈতিক সমধানের মাধ্যমেই সম্ভব।

লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি সতর্ক করে বলেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপদের মুখে রয়েছে লেবানন। বিগত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলার মুখে দেশটিতে উদ্বাস্তু ১০ লাখ মানুষকে ত্রাণসহায়তা দিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেন, ‘উদ্বাস্তু লোকজনকে আমরা ত্রাণসহায়তা দিচ্ছি। আরও জরুরি ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।’

এদিকে লেবাননে জাতিসংঘের ত্রাণসহায়তা–বিষয়ক সমন্বয়ক ইমরান রিজা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে জরুরি ত্রাণসহায়তা দিতে ৪২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো পর্যাপ্ত কিছু করা না গেলে জরুরি সহায়তা না পেয়ে পুরো দেশের মানুষ চরম সংকটের মধ্যে পড়বে। বেসামরিক লোকজনকে নিশানা করে যদি হামলা চলতে থাকে তাহলে যত ত্রাণসহায়তা দেওয়া হোক না কেন, এটা সব মানুষের চাহিদা মেটাতে পারবে না।’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সমন্বয়কের কার্যালয়ের মুখপাত্র লিজ থ্রসেল ইসরায়েলের স্থল হামলা নিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, স্থল হামলার পরিসর যত বাড়বে ততই সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

গত বছরের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই লেবাননে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সাম্প্রতিক সময়ে হামলা জোরদার করলে ইতিমধ্যে কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। মঙ্গলবার ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে ঢুকে হামলা শুরু করার মধ্য দিয়ে এই সংঘাত একটি নতুন মোড় নিল। ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে ঢোকায় গোটা মধ্যপ্রাচ্য সতর্ক অবস্থানে চলে গেছে।

লেবাননে নিয়োজিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের স্থল হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্থল হামলার মধ্য দিয়ে লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলি বাহিনীর লেবানন আগ্রাসনের গভীর নিন্দা জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে দেশটি বলেছে, লেবাননের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত তার আগের অবস্থানে অবিচল রয়েছে। এই সংঘাত যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। একই সঙ্গে বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষার গুরুত্বের বিষয়টি নিয়েও আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মেদ বিন আব্দুলাজিজ আল–খুলাফি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, লেবাননের ওপর আগ্রাসন সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

আব্দুলাজিজ আল-খুলাফি বলেছেন, ‘লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তায় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন সবচেয়ে বেশি জরুরি। লেবাননের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, একই সঙ্গে এর অপরিহার্যতা দেখা দিয়েছে।’

মঙ্গলবারই ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েলি বাহিনী সেগুলোর বেশির ভাগ লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পেরেছে। তবে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে। তাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হওয়া যায়নি।

লেবাননে ইসরায়েলি সেনাদের স্থল হামলা শুরুর পর সব দেশই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। পাশাপাশি সতর্ক করে বলছে, এই সংঘাত যদি পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

লেবানন সংঘাত যাতে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ না নেয়, সে জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও বিবদমান সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাপান। এদিকে রাশিয়া সতর্ক করে বলেছে, সংঘাতের পরিসর বাড়ছে। এতে মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং উত্তেজনা বাড়বে।

লেবাননে স্থল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সরে আসার দাবি জানিয়েছে স্পেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইসরায়েল যদি স্থল হামলা বন্ধ না করে তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে।

শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি–৭–এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইতালির পক্ষ থেকেও সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশটি জানিয়েছে, সংঘাত প্রশমনের লক্ষ্যে কাজ করছে রোম। সংঘাত অবিলম্বে বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর নবনির্বাচিত প্রধান মার্ক রুট্টে। তিনি বলেছেন, লেবাননের চলমান ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তার আশা যত দ্রুত সম্ভব এই সংঘাত থেমে যাবে।

মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর বিষয়ে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি। তিনি বলেছেন, আঞ্চলিক যুদ্ধ হলে তার চড়া মূল্য দিতে হবে। উত্তেজনা প্রশমনে লন্ডনের পক্ষ থেকে ইরানের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে লন্ডনের কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি।

এর আগে সর্বশেষ ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় লেবাননে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলি সেনারা। স্থল হামলা শুরুর আগে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বিমান থেকে নির্বিচার বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল। লেবাননে এবারের স্থল হামলার নাম দেওয়া হয়েছে নর্দার্ন অ্যারোস বা উত্তরের তীর।

লেবাননে গত এক সপ্তাহের টানা ও নির্বিচার বিমান হামলায় কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার বৈরুতের উপকণ্ঠে এক বিমান হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। এ ছাড়া এই কয়েক দিনে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর দাবি, হিজবুল্লাহকে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে লিতানি নদীর উত্তর তীরে পাঠাতেই এই স্থল হামলা শুরু করেছে তারা। ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত থেকে এলাকাটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ