ডা. মো. সাইফুল ইসলাম: সুপ্রিয় পাঠক, ‘এ লজ্জা কার ও দায়ী কে’ প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে কেন জানি না আমি নিজেই লজ্জা পাচ্ছি। মনটা দূর দূর করছে। হৃদয়টা কাঁপছে। লজ্জায় আমার মাথা হিট হয়ে আসছে। তারপরও আমার ভিতর থেকে কোন এক অদৃশ্য শক্তি আমার অনুভুতিকে নাড়া দিয়ে বার বার বলছে, তুমি গাইতে থাক- এ গান তুমি বন্ধ করো না। তোমার এ গান শুনে হয়তোবা লজ্জাহীন মানুষের সিংহভাগ তোমার কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য বুকে তীর মারতে পারে। কারণ লজ্জাহীন মানুষের ভিতরে নৈতিক চরিত্র থেকে আরম্ভ করে মানবতা, মানবিক মূল্যবোধ সহানুভূতি ও সহনশীলতা বলতে কিছুই থাকে না। নির্লজ্জতার কালো ছায়া তাদের অন্তর মন, হৃদয় সর্বোপরি সবকিছুকেই ¤øান করে দেয়। লজ্জাহীন মানুষ পশুর সমান। পশুর সাথে তুলনা করলে হয়তবা ভুল হবে। কারণ পশুরও মধ্যে কিছুটা হলেও যে লজ্জা আছে তা উপলব্ধি করা যায়। কাজেই লজ্জাহীন মানুষ পশুরও অধম। অধমগুলো আবার ভালোকিছু করতে না পারলেও মন্দ সব কিছুতেই যে পারদর্শী অবস্থাদৃষ্টে একথা বলার বা ব্যাখ্যা করার আর প্রয়োজন নেই। স্বার্থ আর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য এমন কোন গর্হিত কাজ নেই, যা তারা করতে পারে না। কাজেই তারা তোমার উপর আঘাত হানতে পারে। ঝরাতে পারে রক্ত। এ রক্ত তোমার বৃথা যাবে না। বরঞ্চ প্রতিটি রক্ত কণিকা থেকে সৃষ্টি হবে অসংখ্য তেজস্বী ও প্রতিবাদী কণ্ঠ। তুমি চিরদিন, চিরকাল থেকে যাবে শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অসহায় মানুষের হৃদয়ের ফুলদানিতে। মৃত্যুও তোমার কাছে পরাজিত হবে। যাক ওসব কথা। এখন প্রশ্ন হলো এই অধমগুলো কারা? অধমগুলো আর কেহই নয়। এদেশেরই অধিকাংশ বিত্তশালী, সমাজপতি, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক শাসকবৃন্দ। এছাড়াও রয়েছে কিছু কিছু সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, জ্ঞানীগুনী ও বুদ্ধিজীবী। এই অধমগুলো কিন্তু নি¤œ শিক্ষিত থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষিতের মধ্যে রয়েছে। এ মুহুর্তে দার্শনিক স¤্রাট নেপোলিয়ানের একটি উক্তি আমার মনে পড়ে গেল যে, ‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দিব’।
এই উক্তিটির মাধ্যমে জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের গুরুত্বের পাশাপাশি তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত হবে, সে জাতি তত উন্নত হবে। উন্নত হবে মানুষের নৈতিক চরিত্র, মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ, অসত্য, অন্যায়, অসুন্দর, অমঙ্গল প্রতারণা, প্রহসন ও স্বেচ্ছাচারীতার কালো থাবা সেই জাতির অন্তর মন ও বিবেককে গ্রাস করতে পারে না। তারা সুন্দর ও কল্যাণের দাসত্ব করবে। কুপ্রবৃত্তিগুলোর কবর রচনা করে সুপ্রবৃত্তির আলোকে দেশ ও জাতিকে আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক স¤্রাট নেপোলিয়নের এই উক্তিটিকে অস্বীকারের উপায় আছে কি? কিছু কিছু জ্ঞানী পাপী ও পাগল ছাড়া সবাই এ সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য। কারণ বিশ্ব আজ যে অত্যাধুনিক সভ্যতার যুগে পদার্পণ করেছে তার মূলেই রয়েছে শিক্ষার অপরিসীম অবদান। জ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে উৎকর্ষিত আধুনিক মানবের কাছে পৃথিবী ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে। কম্পিউটার্স, ইন্টারনেট, স্যাটালাইট-এর অবাধ সৃজনী শক্তির দ্বারা অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী মানব এই পৃথিবীকে এনেছে হাতের মুঠোয়। জয় করে চলেছে আকাশ, পাতাল, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহসমূহ। অগ্রগতির প্রতিযোগিতায় জয়ী দেশগুলো তাই অপরাপর দেশের উপর প্রতিষ্ঠা করে চলেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্তৃত্ব। আমাদের বাংলাদেশও এই অত্যাধুনিক বিশ্বের বাহিরে নয়। অথচ দেশ ও জাতিকে আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে দাঁড় করানো তো দূরের কথা, বরঞ্চ ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতের অতল অন্ধকারে। হাজারোও সমস্যার ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সামর্থকে, নষ্ট করে ফেলেছি আমাদের সৃজনী শক্তিকে, ব্যর্থ হচ্ছি আমাদের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জাতির উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনাময় সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে। পাশাপাশি বিশ্বের কাছে পরিচিত হচ্ছি অসহায়, দারিদ্র-পীড়িত, কর্মবিমুখ ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যেন এক অন্ধকার জগতের ঘুমন্ত বাসিন্দা হিসেবে।
আমাদের দেশ গরীব। আমরা দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছি, একথাও সত্য। ভিক্ষুকের দেশ হিসেবে গোটা বিশ্বে আমাদের পরিচিতি। সার্টিফিকেটও পেয়েছি। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় যে, বাঙ্গালি জাতি কেন ভিক্ষুকের সার্টিফিকেট পেল? ভিক্ষুকের সার্টিফিকেট পাওয়ার পশ্চাতে রয়েছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস। যে ইতিহাস পাকিস্তানি স্বার্থবাদী মহলের জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ তাদের প্রভূত্ব ‘শোষণ’, আধিপত্য ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে নির্মম, নিষ্ঠুর, পাক হানাদার বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল। শান্তিপ্রিয় ও স্বাধীনতা পাগল বাঙ্গালী জাতির উপর। বর্বর পাক হানাদার বাহিনী জাতির মেরুদন্ডসহ সুজলা, সুফলা সোনার বাংলার রুপ, যৌবন, সৌন্দর্য ও লাবণ্য সর্বোপরি সবকিছুকে ¤øান করে দিয়েছিল। পরাজয় নিশ্চিত ভেবে সুপরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক কাঠামোসহ দেশের সবকটি অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর এদেশে কি ছিল? কিছুই ছিল না। ছিল শুধু মাটি। সেও আবার পোড়া মাটি। সেই পোড়া মাটি নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল। স্বাধীনতা পাগল মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে একেবারেই সর্বশান্ত হয়ে পড়েছিল। দুর্ভিক্ষ আর দারিদ্র আষ্টেপৃষ্টে সমগ্র জাতিকে বেঁধে ফেলেছিল। এমতাবস্থায় ভিক্ষুকের সার্টিফিকেট পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই সেই যে সার্টিফিকেট জাতির গর্ব, অহংকার, মান, সম্মান, সম্ভ্রম ও ইজ্জত একেবারেই ¤øান করে দিতে পারেনি। বরঞ্চ বাঙ্গালী জাতির ধৈর্য্য, আত্মবিশ্বাস ও স্বদেশ প্রেম দেখে গোটা বিশ্বের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মাতৃভূমির প্রতি অপ্রতিরোধ্য ভালবাসার বিরল দৃষ্টান্ত, আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের মানুষ মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছিল।
হে নব প্রজন্ম, তোমরা শুনো কান পেতে শুনো। আমি যা বলছি বা লিখছি তা কোন কল্প-কাহিনী বা রুপ কথার গল্প বা শিশুদেরকে ঘুম পাড়ানোর কেচ্ছা কাহিনী নয়। এ এক সত্য বাস্তব ও পানির মত স্বচ্ছ ঘটনা প্রবাহ। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে এদেশেরই অকুতোভয় দামাল সন্তানদের বুকের তাজা রক্ত ও মা বোনের অমুল্য সম্পদ ইজ্জতের বিনিময়ে অতি চড়া দামে বা মূল্যে কেনা এ দেশ। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় পঞ্চাশ বৎসর পরও আজ আমরা রুগ্ন। কেন আমরা স্বাদ, সৌন্দর্য ও লাবণ্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত? যে জাতি রক্ত, জীবন ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে কেনতে পারে ‘মাতৃভাষা’ ও ছিনিয়ে আনতে পারে ‘স্বাধীনতা’। সে জাতির গর্ব অহংকার ’ অপচ্ছায়ার অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেল কেন? কেন ‘স্বাধীনতা’ লাভের ৫০ বছর পরও মাথা উচু করে দাড়াতে পারলো না? কেন সহজ, সরল বাঙ্গালী জাতি আজ অসহায়ের মতো জঘন্য অপবাদগুলো মাথায় নিয়ে নির্বোধের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে? কে বা কারা অপতৎপরতা ও অপকর্মের মাধ্যমে জঘন্য অপবাদ পাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে সমগ্র জাতিকে করছে কালিমালিপ্ত। এ লজ্জা কার ও দায়ী কে? এ লজ্জা সমগ্র জাতির। দায়ী কিন্তু অপরাজনীতি, শিক্ষা নামে কলংক ও জ্ঞান পাপীর দল। (চলমান)
লেখকঃ ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম
কবি, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী।