মঙ্গলবার, ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কলাগাছের তন্তু থেকে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক

আলমগীর হোসাইন, মৌলভীবাজার : পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কৃত্রিম বস্তুগুলোর মধ্যে প্রথম দিকেই রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন উপায় বের হলেও নানা কারণে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি ততটা । তবে এ নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা থেমে নেই। তৎপর রয়েছে আজকের নবীন হবু বিজ্ঞানীরাও।

এই নবীন উদ্ভাবকদেরই একজন মৌলভীবাজারের খুদে বিজ্ঞানী সাজ্জাদুল ইসলাম। পরিত্যক্ত পচা ও অব্যবহৃত সবজির শ্বেতসার থেকে পরিবেশবান্ধব পলিথিন উদ্ভাবন করে রীতিমতো দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি করেছেন টাইলস।

সাজ্জাদুল ইসলাম মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী । কলাগাছের তন্তু দিয়ে তিনি প্লাস্টিক, কার্বন ও সিলিকন পণ্যের বিকল্প ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির ফরমুলা আবিষ্কার করেছেন। একই সঙ্গে সে পচা ও অব্যবহৃত সবজির শ্বেতসার থেকে তৈরি করেছে পচনযোগ্য পলিথিন। সাজ্জাদুলের দাবি তার আবিষ্কৃত এই ফর্মুলা শতভাগ পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী।

সাজ্জাদুল জানান, ‘শুধু টাইলস নয় তার আবিষ্কৃত কাঁচামাল দিয়ে প্লাস্টিক, কার্বন ও সিলিকনে তৈরি প্লাস্টিকের আসবাবপত্র, টিন, টাইলস ও কার্বনের তৈরি মোটরযানের যন্ত্রাংশের বিকল্প হিসেবে কলাগাছের তন্তু ব্যবহার করা সম্ভব। এমনকি বুলেটপ্রুফ দরজা জানালাও তৈরি করা সম্ভব। আবিষ্কৃত কাঁচামালে ৬৫ শতাংশ কলাগাছের তন্তু ও ৩৫ শতাংশ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেই এসব তৈরি করা যায়।

তিনি জানান, তার আবিষ্কৃত প্লাস্টিক পণ্য উচ্চতাপে গলিয়ে সহজেই রাসায়নিক দ্রব্য ও কলাগাছের তন্তু আলাদা করা য়ায়। আর সবজির শ্বেতসার থেকে তৈরি পলিথিন মাটিতে ১ মাসে ও পানিতে ৩ মাসে পচে যাবে; যা মাটির জন্য হবে জৈব সার ও পানিতে হবে মৎস্য খাদ্য।

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হৃদয় কুমার ভৌমিক সাংবাদিকদের জানান, তার কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল কলাগাছের সেলুলোজ সমৃদ্ধ তন্তুর হাইডো-অক্সাইড ও রেজিন ব্যবহার করে এক টুকরো টাইলস তৈরি করে এবং আলুর শ্বেতসার থেকে পলিথিন তৈরি করে এনে দেখায়। পরে আমরা সরকারি কলেজের ল্যাব থেকে তাকে এটি করে দেখানোর আহ্বান জানালে কলেজের ল্যাবে এই দুই পণ্য তৈরি করে। এ সময় কলেজের অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তা দেখেন।প্রভাষক হৃদয় কুমার বলেন, ‘সে যে কাঁচামাল ব্যবহার করেছে তা পরিবেশের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আরও অধিক গবেষণায় এটি ভালো কোনো আবিষ্কার হতে পারে।’

সাজ্জাদুল বলেন কলেজের বলেন, ‘যেহেতু এর প্রধান কাঁচামাল কলাগাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং কলাগাছ সহজলভ্য; তাই এটির ব্যবহারে গ্লাস ফাইবার ও কার্বন ফাইবারের প্রয়োগ কমবে। আর তার আবিষ্কৃত এ পলিথিন পরিবেশের ওপর অপচনশীল পলিথিনের প্রভাব কমাবে।’ সাজ্জাদুলের মাধ্যমিক শেষ করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিদ্যালয় মোহাজেরাবাদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে।তার মাধ্যমিকের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও বর্তমান হুগলিয়া হাজী মনছব উল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কামরুল হাছান জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই সাজ্জাদুলের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আবিষ্কারের উপর কৌতুহল ছিল। মূলত মাধ্যমিক থেকেই তার বিভিন্ন কিছু আবিষ্কারে মনোযোগ আসে। সাজ্জাদুল ইতোমধ্যে কলাগাছের তন্তুকে ব্যবহার করে তৈরি করেছে টাইলস আর অব্যবহৃত সবজির শ্বেতসার থেকে তৈরি করেছে পরিবেশবান্ধব পলিথিন।’

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক বিজন চন্দ্র দেবনাথ ব সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেহেতু এর প্রধান কাঁচামাল কলাগাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাই এই কাঁচামাল দিয়ে পলিথিন তৈরি করলে পরিবেশের ওপর অপচনশীল প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমবে।’ এ বিষয়ে ক্ষুদে বিজ্ঞানী সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, কলাগাছের তন্তু থেকে এই কঠিন যৌগ তৈরি করতে তার সর্বোচ্চ ৬৫ ভাগ তন্তু দিলে এর মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণ হবে। সে জানায়, তার তৈরি টাইলসের ওজন পায় ৩০০ গ্রাম। যার মধ্যে ২০০ গ্রাম কলাগাছের তন্তু ও হাইডোঅক্সাইড ৬০ গ্রাম ও রেজিন ৪০ গ্রাম। সে জানায়, রেজিন ব্যবহার করা হয় এ জন্য যেন দীর্ঘ সময় ধরে এটি না পঁচে এবং হাইডো-অক্সাইড রেজিনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী অবস্থান প্রদান করে। এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী আরও জানান, পরিবেশবান্ধব পলিথিনের জন্য সে ব্যবহার করে বাজারের পরিত্যক্ত সবজি থেকে সংগ্রহকৃত শ্বেতসার, অ্যাসিটিক এসিড ও গ্লিসারল। মোট দ্রবণের ২৫ শতাংশ গ্লিসারল, ২৫ শতাংশ অ্যাসিটিক এসিড, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পানি ও বাকিটা সবজির শ্বেতসার।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ফল ও সবজি অপচয় হয়। এই অপচয়কৃত শস্য থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি করা হলে দেশের অর্থনীতিতে আসতে পারে বড় একটা পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে পরিবেশ দূষণ। আর কলাগাছ যেহেতু একবার ফল দেওয়ার পর কেটে ফেলে দিতে হয়। তাই কৃষককে অল্প মূল্য দিয়ে তা সংগ্রহ করে এর দ্বারা প্লাস্টিক, কার্বন ও সিলিকন পণ্যের বিকল্প ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করা সম্ভব।

ইতোপূর্বে সাজ্জাদুল ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা-২০২৪’ এ মৌলভীবাজার জেলা পর্যায়ে বছরের সেরা মেধাবী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। সে জানায়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সে তার গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সাজ্জাদুলের বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। তার বাবার পক্ষে তার গবেষণার খরচ চালানো সম্ভব নয়। তাই তার এ কাজের উৎসাহ অর্থনৈতিক কারণে সামনের দিকে এগোচ্ছে না। এই মেধাবী ক্ষুদে বিজ্ঞানীকে সরকার কিংবা হৃদয়বান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করলে তার দ্বারা ভালো কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তার শিক্ষকরা।

সাজ্জাদুলের উদ্ভাবিত টাইলসের ওজন পায় ৩০০ গ্রাম। এর মধ্যে রয়েছে ২০০ গ্রাম কলাগাছের তন্তু ও হাইড্রো অক্সাইড ৬০ গ্রাম এবং রেজিন ৪০ গ্রাম। দীর্ঘ সময় ধরে পণ্যটি যেন না পচে এ জন্য রেজিন ব্যবহার হয়। হাইড্রো অক্সাইড রেজিনের অবস্থানকে আরও শক্তি দেয়। আর পরিবেশবান্ধব পলিথিনের জন্য ব্যবহার হয় বাজারের পরিত্যক্ত সবজি থেকে সংগ্রহ করা শ্বেতসার, অ্যাসিটিক এসিড ও গ্লিসারল।


সাজ্জাদুলের দাবি, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ফল ও সবজি অপচয় হয়। এই অপচয় করা শস্য থেকে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করা হলে দেশের অর্থনীতিতে আসতে পারে বড় পরিবর্তন। পাশাপাশি কমে আসবে পরিবেশ দূষণ।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ