
সৈয়দ রিয়াদ মিয়া : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর সার্বিক প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষিতে। খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকার রাখছে দেশের কৃষি খাত। কৃষিক্ষের গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জীবিকা নির্বাহের প্রধান খাত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর প্রভাব পড়েছে দেশের প্রান্তিক মানুষের উপর, যাদের বেশিরভাগই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে একীভূত হয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে আবহাওয়া যে ধরণের পরিবর্তন হয়েছে তাতে কৃষি-স্বাস্থ্যসহ জনজীবনে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এর থেকে উত্তরণে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। বুঝতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে সমস্যা হচ্ছে, এগুলো কোনো একটি দেশের একক সমস্যা নয়। এটা বৈশিক সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ইতোমধ্যেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্ঠ সর্বোচ্চ ১ মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে। এ পূর্বাভাস সত্যে পরিণত হলে বাংলাদেশকে উষ্ণ এলাকার কৃষিসহ সব কিছুই হারাতে হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা, ঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উচ্চতাপমাত্রা, ফ্ল্যাশ বন্যা ইত্যাদির তীব্রতা ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশে আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনন্য অবদানকারী হলো কৃষিক্ষেত্র। শস্য উৎপাদন গ্রামীণ আয় বৃদ্ধি করে এবং দরিদ্র মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবেচেয়ে ঝুঁকিতে আছে কৃষি খাত।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বন্যা এবং জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি ফসলের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। দেখা গেছে যে, উদ্ভিদ, প্রজনন ও পাকা পর্যায়ে বৃষ্টিপাতের ফলে ১ মিনি বৃদ্ধি আমন ধানের উৎপাদন যথাক্রমে ০.০৩৫, ০.২৪০ এবং ০.২৮২ টন হ্রাস পেয়েছে। পানির ঘাটতি ফসলের উৎপাদন সীমাবদ্ধ করে। সেখান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সরবরাহ করা সেচের ৪০১ জন। কভারেজ মাত্র ৫ শতাংশ।
সম্প্রতি শস্য উৎপাদনের ওপর সমুদ্রের স্তনের প্রভাব ক্রমশই বাড়ছে। তিনভাবে এই প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ দ্বারা, বন্যার দ্বারা এবং ঘূর্ণিঝড়ু বৃদ্ধির কারণে। এই তিন কারণে সংযুক্ত প্রস্তাব উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্র হ্রাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থানের কারণে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশে মিঠাপানির অভাব এবং মাটির অবক্ষয়ের ফলে কৃষিক্ষেত্র হ্রাস পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ততা ভবিষ্যতে হয়েছে। আরো তীব্র সমস্যা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সাতক্ষীরার একটি গ্রামে ধানের উৎপাদন হ্রাস তদন্ত করে জানা যায়, ২০০৩ সালে ধানের উৎপাদন ১৯৮৫ সালের তুলনায় ১,১৫১ টন কম ছিল। মোট হ্রাসপ্রাপ্ত উৎপাদনের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ধানখেতকে চিংড়ি পুকুরে রূপান্তর করার কারণে এবং ২৩ শতাংশ ফলন হ্রাসের কারণে হয়েছিল।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ২০টি খরা পরিস্থিতি ভোগ করেছে। ১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে গরা শুধু বর্ষার ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে খবার পরিস্থিতি ১৯৯০ সালের দশকে ৩.৫ মিলিয়ন টন ধানের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল।
চলতি বছরে সুনামগঞ্জ সিলেট অঞ্চলে বন্যার কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সিলেটে তিন দফা বন্যায় বোরো, আউশের বীজতলা, আউশের ফলন, সবজি, বোনা আমন ও চিনাবাদামে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবমি নিয়ে এক হাজার ১১৩ কোটি ৮৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৪ লাখ ২৯ হাজার
জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের (এনএআরএস) আওতাধীন সংস্থাগুলোর গবেষণার গবেষকরা এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নিযুক্ত আছেন, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্থিতিশীল এবং প্রত্যাশিত শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করে। গবেষণা ও স্ট্রেসের বিকাশ (লবন, নিম্নজা খরা, উচ্চতাপমাত্রা) সহনশীল চাল এবং গমের জাতগুলো ২০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। বিআরআরআই-৪ জাতের বীজ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দ্বারা গুণিত হয় এবং লবণাক্তপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো চাষের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) দ্বারা প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি ইনস্টিটিউট (বিআইএনএ)-এর বিহার-৩০ এবং বিআইএনএ-এ-এর মতো মেয়াদি জাতগুলোর উদ্ভাবন উত্তর বাংলাদেশের তথাকথিত মঙ্গাপীড়িত অবস্থাকে এড়াতে সফলভাবে চাষ করা হয়। বিআরআরআই চাল-৩২ এবং বিআরআরআই চাল ৫২ আকস্মিক বন্যার সময় ডুবে থাকতে পারে।
বহু সময় ধরে এটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে এটি একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক, তবে বাংলাদেশের জন্য যেখানে জীবন ও জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল, এটি জাতীয় খাদ্য সুরক্ষার জন্য একটি বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।