মো. শফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: দেশে জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বন্দর নগরীর চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে অপরাধ কর্মকান্ড। মাদক,জুয়া,পতিতাবৃত্তিসহ নানান অপরাধের সাথে সংযুক্ত সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের নজর এড়াতে সময়ের সাথে পাল্টাচ্ছে তাদের অপরাধের কৌশল। এর মধ্যে মাদক ও জুয়ার মত সামাজিক ব্যাধিটিকে পুজি করে সাধারন জনগনের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল দুর্বিত্ত। এতে সাজানো গোছানো সংসার ধ্বংশ হচ্ছে আর এইসব দেখে কোমল মতি শিশুরা হচ্ছে বিপথগামী।
চট্টগ্রাম নগরীর পাচলাইশ থানাধীন ব্যস্ততম রেল পথ ষোলশহর স্টেশন হয়ে উঠেছে চুরি ছিনতাইসহ মাদক ও জুয়ার হটস্পট। সেখানকার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে বসছে জুয়ার আসর। প্রশাসনের নজর এড়াতে মুঠোফোনে প্রযুক্তির ব্যবহার করেও চলছে অনলাইন জুয়া।আর সন্ধ্যা গড়ালেই মাদকের গন্ধে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। এছাড়াও শিক্ষার্থী ও পথচারীদের একা পেলেই মোবাইলসহ সর্বস্ব লুটে নেয় কিশোর গ্যাং এর সন্ত্রাসীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চা নাস্তার দোকানসহ হোটেল গুলোতে দল বেধে মানুষ চারদিক ঘিরে কোন একটি বিষয়ের উপর গভীর মননিবেশ করেছেন। আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখা যায় তাসের বান্ডেল ভাগ হচ্ছে খেলোয়ারদের মধ্যে। অন্যদিকে মোবাইলে চলছে লুডু। পাশে রাখা টাকা দেখে বুঝতে বাকি থাকেনা চলছে জুয়া খেলা। প্রকাশ্যে জুয়ার আসর চলছে কিন্তু কারো যেন কোন মাথা ব্যাথাই নেই।
এদিকে পশ্চিমের আকাশের সূর্য ডুবতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন রেলস্টেশনে কিছু লোকজন দের গতিবিধি বেশ উদ্বেগ জনক ও রহস্যময়। তাদের হাত থেকে কাজে মোড়ানো কিছু একটা চলে যাচ্ছে ভিন্ন গন্তব্যে। বিনিময় হিসেবে কাজ করছে টাকা। এইসব দৃশ্য চোখে বন্ধি যথেষ্ট নয় ক্যামেরা বন্ধি করতে একটু সামনে এগোতেই তাদের নজর থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। অবস্থা বুঝে ছিটকে পরলেন তারা। অন্ধকার থাকার কারনে তাদের অবস্থান খুজে বের করা দুষ্কর। কাগজে মোড়ানো কি বিক্রি হচ্ছে তা বুঝা যায় একধরনের বিটকে গন্ধে সিগারেটের আদলে মোড়ানো কিন্তু গন্ধ নাকে লেগে জ্বালার সৃষ্টি করে। স্টেশনটি ঘুরে দেখা যায় গাঁজাসহ ইয়াবা সেবনের ভয়াবহ দৃশ্য। শিক্ষার্থসহ শিশুদের সামনেই চলে মাদক সেবন।
তথ্য মতে, স্টেশনটিতে চুরি,ছিনতাই, মাদক ও জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ করে কিশোর গ্যাং লিডার কানা সবুজ, জাহেদ, মহসিন, রুবেল, ইমন, হেলাল, জালাল, জামাই ইসমাইল, অপুসহ এলাকাটির চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সামাজিক সংগঠন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, থানা পুলিশের অসৎ কর্মকর্তাদের লোক পরিচয়ে মাদক ও জুয়ার আসর গুলো পরিচালিত হয়। সোর্স পরিচয়ে নিয়মিত উত্তোলিত চাঁদার একটি অংশ নিয়ে যায় অপর একটি পক্ষ।
তিনি আরো জানান, বিভিন্ন সময় র্যাব ও ডিবি পুলিশ অভিযান চালালেও থানা পুলিশের যেন কোন দ্বায়িত্ব নেই এলাকাটিতে। নেশায় আসক্ত ব্যক্তিরা প্রতিনিয়তই উশৃংখল আচরন করেন স্টেশন টিতে আসা লোকজনের সাথে। এছাড়াও স্টেশনটিতে আসা যাত্রী, শিক্ষার্থীসহ পথচারীদের একা পেলেই চারদিক ঘিরে ধরে টাকা, মোবাইলসহ লুটে নেয় মূল্যবান সামগ্রী।
স্টেশনটি নিয়মিত ব্যবহারকারী মো. নাহিদ নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বললে তিনি জানান, তিনি স্টেশনটি ব্যবহার করে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা যাওয়া করেন, গত কয়েক মাস আগে সন্ধার সময় স্টেশনে নেমে রেললাইন ধরে ২নং গেইট যাওয়ার সময় কয়েকজন কিশোর সন্ত্রাসী তাকে ঘিরে ছুরি দেখিয়ে মোবাইল ও মানি ব্যাগ ছিনতাই করে চলে যান এবং তারা যেতে যেতে হুমকি দিয়ে বলে যায়, “থানায় গেলে একদম ভূরি ফালাই দিমু”। থানায় অভিযোগ করেছেন কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ভাই আমি চট্টগ্রামে নতুন, থানা কোথায়! কোন থানা এসব আমি কিছুই জানি না বলে, এ বিষয়টি নিয়ে আর কিছু বলে কোন লাভ হবে না এমন আক্ষেপ করে শিক্ষার্থী টি চলে যান।
প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেন শ্যামলী আইডিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর ডিপ্লোমা পড়ুয়া শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান তৌহিদ। তিনি বলেন, গত বছর একদিন ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার সময় কয়েকজন ছেলে এসে আমার সাথে ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা খেয়ে আমার সাথে হাতাহাতি লাগিয়ে দেয়। পরে টিপ ছুরি বের করে আমার মোবাইলটি নিয়ে যায় এবং আমার মানিব্যাগ আছে কিনা দেখতে তাদের একজন পকেটে হাত দিয়ে চেক করে কিছু না পেয়ে আমার গালে থাপ্পর মেরে চলে যায়। সে সময় স্টেশনটিতে মানুষ ছিলই না বলতে গেলে এই সুযোগে তারা এগুলা করে। তিনি জানান, এর পর থেকে আমি একা ঐ স্টেশন দিয়ে চলাফেরা করি না।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি গনমাধ্যমকে জানান, জুয়ার আসর চলার তথ্য পেয়ে ২৭ ডিসেম্বর রাতে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ঘটনা স্থল থেকে ০৩ জুয়ারী কে আটক করতে সক্ষম হই। এই অভিযান চলমান থাকবে। তিনি আরো বলেন, তথ্য থাকলে আমাদের দিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পূর্বান্চল রেলওয়ের চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনের দ্বায়িত্বরত স্টেশন মাস্টার ফখরুল আলম পারভেজ বলেন, স্টেশনের অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ে কাজ করে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), তাদের দ্বায়িত্বে পড়ে নিরাপত্তার বিষয়টি। চলমান অপরাধ কর্মকান্ডগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি এইসব বিষয় থেকে দূরে থাকি। আমি শুনেছি ২৭ ডিসেম্বর পুলিশের অভিযানে ৩জন গ্রেফতার হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করি এসব অপরাধ কর্মকান্ড বন্ধ করতে। (আরএনবি) এর আগে চিঠিপত্র দিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে। এখন ব্যবস্থা নেওয়া তাদের দ্বায়িত্ব।
পূর্বান্চল রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটি থেকে দক্ষিন চট্টগ্রামের দোহাজারীসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গামী ট্রেনচলাচল করে। চলমান মেগা প্রকল্প চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের মধ্যে এই স্টেশনটি অন্যতম গুরুত্ব বহন করে।
প্রতিদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ নাজিরহাট- দোহাজারী পথের হাজার হাজার যাত্রী এই স্টেশনটি ব্যবহার করে।
যাত্রীদের মতে, শহরের এই স্টেশনটির চারিদিকে নগর পুলিশের একাধিক থানা থাকার পরও চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন, জুয়াসহ অপরাধ সংগঠিত হওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার প্রকাশ পায়।