যায়যায়কাল প্রতিবেদক: নগদ টাকা নিয়ে সংকটে থাকা ছয়টি ব্যাংকের লেনদেন স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য এসব ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আরও টাকার প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই সহায়তা দেবে। সব ব্যাংক আমানতকারীর পাশে সরকার আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তারল্য নিয়ে যে ছয়টি ব্যাংক সমস্যায় রয়েছে, সেই ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর। এই ছয়টি ব্যাংক হলো ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে বড়ভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এসব ব্যাংক নিবিড় তদারকিতে রাখা হয়েছে। গ্রাহকের স্বার্থ দেখতে আমরা বদ্ধপরিকর। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রত্যেক আমানতকারীর জমা করা অর্থের সুরক্ষা দেওয়া হবে। কোনো ব্যাংকে তারল্য সমস্যা হলে তাতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তারল্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সহায়তা দেওয়া হবে। আমানতকারীদের স্বার্থ পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ব্যাংকের সব শাখা থেকে গ্রাহকেরা তাদের চাহিদামতো টাকা তুলে পারছেন। আগামী দিনেও কোনো সমস্যা হবে না।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আহসান মনসুর বলেন, ‘একটি ব্যাংকের সব গ্রাহক টাকা তুলে ফেলতে চাইলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংকই সব টাকা একসঙ্গে ফেরত দিতে পারবে না। তাই আমরা গ্রাহকদের বলব, সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে যাবেন না। যে ব্যাংকেই টাকা থাকুক না কেন, তা নিরাপদ থাকবে। ব্যাংকে থাকা আমানত নিরাপদ থাকবে, আমরা সেই মর্যাদা দেব। ব্যাংকে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকা ছাপানোর বিপক্ষে ছিলেন গভর্নর, এখন কেন সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললেন, এ প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা ছাপানো হবে না, এ সিদ্ধান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাময়িকভাবে সরে এসেছে। তবে ব্যাংকগুলোকে তারল্যসহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পুরোপুরি টাকা ছাপানো বলা যাবে না। এখানে এক হাতে বাজার থেকে টাকা তুলে অন্য হাতে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে। মুদ্রানীতি আগের মতো সংকোচনমূলক থাকবে।
আগের সরকারের সময়ে যেভাবে টাকা ছাপানো হয়েছে, তার সঙ্গে এর পার্থক্য কী, তা জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘এসব ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। টাকা চুরি বন্ধ করা হয়েছে। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। সূচকগুলো নিয়মিত তদারকির মধ্যে আনা হয়েছে। বাচ্চারা ললিপপ চাইলে বাবারা যেমন দিতে থাকেন, আগে এভাবে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক ইসলামী ব্যাংককে ছাপিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার কোনো হিসাব মেলেনি।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘১০ টাকা ধার দিয়ে ১০ টাকা বাজার থেকে তুলে নিলে কোনো সমস্যা হবে না। এটা একধরনের স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহারের মতো। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে টাকা ছাপানো বৃদ্ধি পাবে না। আমাদের বড় লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি কমানো ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা।’
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে অতিরিক্ত তারল্য বাজার থেকে তুলে নেয়। এর মাধ্যমে সাধারণত সরকারি বন্ড বিক্রি করে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে অতিরিক্ত অর্থ সরিয়ে নিয়ে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি কমায়। বাজার থেকে টাকা তুলে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৯০ ও ১৮০ দিন মেয়াদি বিল চালু করেছে। এই টাকা সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোকে ধার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা তোলা হবে। এসব শেয়ার যারা কিনবে, সেই নতুন মালিকেরা ব্যাংক পরিচালনা করবে। আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো তদারক করেনি, এখন করা হচ্ছে।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে জনগণের আস্থা থাকা উচিত। জনগণের জন্য যেটা ভালো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সেই উদ্যোগ নেবে। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় যা প্রয়োজন, তা–ই করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের যে সমস্যা, তা মিটে যাবে। যে মূলধন–ঘাটতি আছে, তা–ও পূরণ করা হবে। শেয়ার বিক্রি করে বা নতুন শেয়ার ছেড়ে মূলধন বাড়ানো হবে। ব্যাংক খাতের যে সমস্যা আছে, তা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সমস্যায় পড়া এক্সিম ব্যাংক ছাড়া সব কটির নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কাছে। এই গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম। এ ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, তিনি (এস আলম) যে ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছেন, সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আইনগতভাবে এসব বিষয় দেখা হবে। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে মামলা প্রস্তুত করা হবে। তার আগে তার নেওয়া ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ আছে, তার মান নির্ণয় করা হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এরপরই আমরা সামনে এগোব। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে খারাপ পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম দায়ী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।’