যায়যায় কাল প্রতিবেদক : সরকারের ‘অতি সংবেদনশীল সার্ভার’ থেকে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘অপরাধী চক্র’র কাছে বিক্রি করায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা শাস্তির মুখে রয়েছেন।
গত ২৮ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তার নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার-এনটিএমসি।
এর পর থেকে পুলিশের দুটি ইউনিটকে সরাসরি এনটিএমসি সার্ভারে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার যোগাযোগ করা হয় এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, খবরটা সত্য।”
তথ্যপ্রযুক্তির খবরনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘টেকক্রাঞ্চ’ বুধবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে সাতটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এনটিএমসি। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি- এমন সব সন্দেজভাজন ব্যক্তির ফোন কল, মোবাইল রেকর্ড ও অনলাইন কার্যক্রম অর্থাৎ তাদের পুরো টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করে সরকারের নির্দেশ মত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দাদের সরবরাহ ও সমন্বয় করা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কাজ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বিশেষ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা এনটিএমসির
তথ্য সংগ্রহের পুরো প্রক্রিয়াই অত্যন্ত গোপন ও সংবেদনশীল, যা ফাঁস হলে রাষ্ট্রের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সেই সার্ভারে ঢুকে সংবেদনশীল তথ্য যোগাযোগের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘টেলিগ্রাম’ চ্যানেলের একটি ‘গ্যাং’ এর কাছে বিক্রি করেছেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা, যার সত্যতা নিয়ে পেয়েছে এনটিএমসি।
নাগরিকদের যেসব তথ্য ‘চুরি’ করে বিক্রি করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মোবাইল নম্বর, কল রেকর্ড, ইমেইল অ্যাড্রেস, জাতীয় পরিচয়পত্রের বৃত্তান্ত এবং অন্যান্য একান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
এনটিএমসির পরিচালনা প্রক্রিয়া অনুযায়ী, পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটি করে আইডি ও পাসওয়ার্ড রয়েছে, যার সাহায্যে তারা এনটিএমসির বিশেষ পোর্টাল ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফরম-এনআইপি’ এ ঢুকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। ওই আইডি ও পাসওয়ার্ডের অপব্যবহার করে দুই কর্মকর্তা অনলাইন মার্কেটে তথ্য বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ।
এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখান থেকে তথ্য নিয়ে তারা বিক্রি করত ফেইসবুক, টেলিগ্রাম চ্যানেলে। আমরা সেগুলো শনাক্ত করেছি এবং তাদের শাস্তির জন্য চিঠি লিখেছি। একই সঙ্গে তাদের লাইন ডিসকানেক্ট করে দিয়েছি।”
নির্দিষ্ট করে দুই কর্মকর্তার কথা বলেছেন তিনি। আমরা এরকম দুইজনকে শনাক্ত করেছি। এদের একজন পুলিশের, আরেকজন র্যাব-৬ এর কর্মকর্তা। পরবর্তীতে এনটিএমসির চিঠির ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য র্যাব ও পুলিশের কাছে চিঠি লিখেছে।
কীভাবে এনটিএমসির তথ্য চুরি হল, সার্ভারে কোনো ত্রুটি বা এ ধরনের কোনো কিছু আছে কিনা, জানতে চাইলে জিয়াউল আহসান বলেন, এখানে আমাদের কোনো দুর্বলতা নেই। আমাদের সিস্টেমের ভেতরে যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো তথ্য অন্যভাবে নেয়, সেটা আমরা সহজেই শনাক্ত করতে পারি।
পুলিশের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্য চুরি করে বিক্রির ঘটনা ধরা পড়ার পর তা অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে সই রয়েছে এনটিএমসির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরের।
তাকে উদ্ধৃত করে টেকক্রাঞ্চ লিখেছে, ওই দুটো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই বিভাগীয় তদন্ত চলছে। উভয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিঠি বক্তব্য থেকে টেকক্রাঞ্চ জানাচ্ছে, তদন্তকারীরা এনটিএমসির ‘লগ ইন’ পরীক্ষা করে ওই দুই কর্মকর্তার সার্ভারে ঘন ঘন প্রবেশের বিষয়টি ধরে ফেলেন। তাদের পরিচয়ও শনাক্ত হয়। অভিযুক্ত দুজনের মধ্যে একজন সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত পুলিশের এন্টি-টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার, আরেকজন র্যাব-৬ এর সহকারী পুলিশ সুপার।
টেকক্রাঞ্চ লিখেছে, এনটিএমসির নিজস্ব তদন্তে বলা হয়েছে- পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা অন্যদের চেয়ে ঘন ঘন এনআইপি সার্ভার পোর্টালে প্রবেশ করেছেন এবং এমন সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যা তাদের কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এনটিএমসির পরিচালক মোহাম্মদ বাকেরকে উদ্ধৃত করে টেকক্রাঞ্চ বলছে, এখানে বেশ কয়েকটি টেলিগ্রাম চ্যানেল রয়েছে, যার একটি হচ্ছে ‘বিডি সাইবার গ্যাং’। ওই দুই কর্মকর্তা অন্তত একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের পরিচালনাকারীদের (এডমিন) কাছে তথ্য পাঠিয়েছিলেন, যেটা পরে বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছে।
চিঠির ভাষ্য ও মহাপরিচালকের বক্তব্য অনুযায়ী, তদন্তের কারণে এখন পুলিশের এটিইউ এবং র্যাব- ৬ এর কোনো সদস্যই ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফরম ব্যবহার করতে পারছেন না। তাদের সবার আইডি স্থগিত রাখা হয়েছে। অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।
অবশ্য মোহাম্মদ বাকের টেকক্রাঞ্চকে বলেছেন, এখন এটিইউ বা র্যাব- ৬ এর কোনো কর্মকর্তা প্রয়োজন মনে করলে তারা পুলিশ সদর দপ্তর বা র্যাব সদর দপ্তরের মাধ্যমে এনটিএমসির কাছ থেকে তথ্য নিতে পারবেন।
এনটিএমসির তথ্য অপব্যবহারের আশঙ্কা নিয়ে আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ফ্রিডম হাউস উদ্বেগ প্রকাশ করে একে ‘নাগরিকদের ওপর নজরদারির প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
গত বছর অয়ার্ড নামে একটি নিউজ পোর্টালের খবরে একজন নিরাপত্তা গবেষকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের এনটিএমসির সার্ভার থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে হচ্ছে, ফলে এটি নিরাপদ নয়। ফাঁস হওয়া তথ্যের মধ্যে ব্যক্তির ইমেইল, মোবাইল রেকর্ড, অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সবই রয়েছে।
‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখা থেকেও গত বছর নাগরিকের সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হয়ে যায়।
গত বছরের দুটি ঘটনা নিয়েই প্রতিবেদন করেছিল টেকক্রাঞ্চ। আর ফাঁসের ঘটনা দুটি উদ্ধার করেছিলেন গবেষক ভিক্টর মার্কোপলোস, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ‘বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটি’র সঙ্গে কাজ করেন।
টেকক্রাঞ্চ বলছে, এনটিএমসির তথ্য বিক্রির ঘটনা তদন্তাধীন থাকলেও এখনও কিছু কর্মকর্তা বাংলাদেশের নাগরিকদের সংবেদনশীল তথ্য বিক্রির করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।