এস রহমান সজীব, জয়পুরহাট: ঢোলের বাজনা, আর কাঁসার ঘণ্টার তালে তালে লাঠির কসরত। এদিকে প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত, আবারও পাল্টা আঘাত। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন লাঠিয়ালরা।
আর সেখানে উপস্থিত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষরা তাতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
আধুনিক সভ্যতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পশ্চিম দেওগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা ও প্রাচীন গ্রামীণ মেলা। মেলায় আশপাশের গ্রাম ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে হাজারও মানুষের আগমন ঘটে।
এ মেলা প্রায় দেড়শ বছর থেকে হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। লাঠিখেলা আর মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা। শুধুমাত্র বাপ-দাদার পুরনো এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তারা বিনা পারিশ্রমিকে এ খেলা চালিয়ে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আগামী প্রজন্মের কাছে এ খেলা থাকবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তারা।
গ্রামবাসীরা জানান, প্রতিবছর জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পশ্চিম দেওগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার দশমীর তিনদিন পর আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী এই গ্রামীণ মেলা। দেড়শ’ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া এ মেলার প্রধান আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা।
মেলাকে ঘিরে জামাই এবং স্বজনদের আপ্যায়ন চলে মেলা সংলগ্ন আশপাশের কয়েক গ্রামে। লাঠি খেলা মূল আকর্ষণ হলেও মেলায় বসে রকমারি মিষ্টির দোকান। যেখানে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি ও চিনির শাহী জিলাপি আকৃষ্ট করে মেলায় আসা দর্শকদের। মেলায় বাঁশ কাঠ, লোহার ও মাটির তৈরি সংসারের বিভিন্ন সামগ্রী নজর কাড়ে মানুষের। শিশুদের খেলাধুলার জিনিষপত্র এবং কসমেটিক্স এর দোকানও বসে এ মেলায়। জামাই-মেয়ের পাশাপাশি স্বজনদের আপ্যায়নের রীতি এলাকায় চলে আসছে এ মেলাকে ঘিরেই। মেলার দিন দুপুরে প্রতিটি বাড়িতে ধুমধামে খাওয়া-দাওয়া হয়। মেলার দিন লাঠিয়ালেরা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে লাঠি খেলা দেখান। বিকেল লোকজন মেলায় পুরোদমে কেনা-কাটা করেন। গভীর রাত পর্যন্ত মেলা চলে। তাছাড়া কাল দুপুর পর্যন্ত চলবে এই মেলা।
মেলায় আসা আনিছুর রহমান বলেন, আমার বাড়ি আক্কেলপুর উপজেলার রোয়াইড় গ্রামে। এ গ্রামে আমার নানার বাড়ি। তাই লাঠিখেলার মেলা উপলক্ষে আমার পুরো পরিবারকে দাওয়াত করা হয়। লাঠিখেলার মেলা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য শৈশবে ফিরে নিয়ে যায়।
আব্দুস সালাম নামের এক বৃদ্ধ বলেন, অন্য কোনো উৎসবে জামাই-মেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত না করলেও সমস্যা থাকে না। কিন্তু পূর্ব পুরুষদের রীতিনীতি অনুযায়ী লাঠি খেলার মেলায় তাদের দাওয়াত দিতেই হবে।
জেমিয়ার হোসেন বলেন, আমার বাসায় ২০-২৫ জন আত্বীয়-স্বজন এসেছেন। আমরা গ্রামবাসীরা সবাই মেলার জন্য অপেক্ষা করি। মেলার জন্য আমাদের সবার আলাদা বাজেট থাকে। ঈদের চেয়ে আমরা মেলায় বেশি আনন্দ করি। মেলায় নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়। এটা আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল গফুর খাঁন বলেন, আমার বয়স এখন নব্বই বছর। আমি ছোট থেকেই আমাদের গ্রামে লাঠিখেলার মেলা দেখছি। এ মেলাকে ঘিরে আমাদের গ্রামে উৎসব বিরাজ করে। আত্মীয়-স্বজনেরা আসেন। গ্রামের রীতি অনুযায়ী তাদের খই, মুড়ি, নাড়ু ও মাংস ভাত অ্যাপায়ন করা হয়।
বৃদ্ধ লাঠিয়াল হাফিজার রহমান বলেন, আমার বাপ-দাদারা লাঠি খেলা করেছে। তাদের কাছ থেকে লাঠি খেলা শিখেছি। আমি ১৯৮০ সাল থেকে লাঠি খেলা করছি। আমাদের লাঠি খেলা দেখে লোকজন আনন্দ পায় তাতে আমরা খুশি হই।
কিশোর লাঠিয়াল স্বাধীন হোসেন বলেন, আমার বাবা লাঠি খেলা করে। আমি তার কাছ থেকে লাঠি খেলা শিখেছি। এখন নিজেই লাঠি খেলা করি। আমাকে লাঠি খেলা করতে খুব ভালো লাগে।
দেওগ্রাম লাঠিখেলা মেলা কমিটি সদস্য আজিজার রহমান জানান, এই মেলা দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। মেলার মূল আর্কষণ লাঠি খেলা। এ মেলাকে ঘিরে আশেপাশের জেলা থেকে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। ঐহিত্যবাহী এ মেলাকে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।