যায়যায়কাল প্রতিবেদক: গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সময়ে তার ভাগ্নি, ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক ও তার পরিবার যেসব সম্পত্তি ‘উপহার’ পেয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করার পাশাপাশি তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তদন্তে যদি প্রমাণ হয় যে টিউলিপ এসব ‘ডাকাতি’র সুবিধাভোগী, তাহলে সম্পত্তিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
ইউনূস মনে করেন, যুক্তরাজ্যে যেসব সম্পত্তির সঙ্গে টিউলিপের যোগসূত্র বেরিয়ে আসছে, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ তদন্তের অংশ হিসেবে সেগুলোর বিষয়েও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
ইউনূসের এমন মন্তব্যের পর যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান কেমি বাডেনকও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে টিউলিপকে বরখাস্ত করতে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক সংকট হতে পারে মন্তব্য করে এক এক্স পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘সিদ্দিকের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর (স্টারমার) দুর্বল নেতৃত্ব এটাই বোঝাচ্ছে যে, সততার গুরুত্ব নিয়ে তিনি মুখে যা বলেন, আদতে ততটা গুরুত্ব তিনি দেন না।’
বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদক যে তদন্ত শুরু করেছে, সেখানেও টিউলিপের নাম এসেছে।
টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতা করেছিলেন। বাজারদরের চেয়ে বেশি খরচের ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা) ‘আত্মসাৎ’ করেছেন।
এর ধারাবাহিকতায় হাসিনা ও টিউলিপসহ তাদের পরিবারের সাত সদস্যের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক অপরাধ বিষয়ক কর্মকর্তারা।
ব্রিটিশ সরকারের সিটি মিনিস্টারের যে দায়িত্ব পালন করছেন ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ, তাতে আর্থিক খাতের দুর্নীতি দমন করাও তার কাজের অংশ। সেখানে বাংলাদেশের তদন্তে টিউলিপের নাম আসার পর ব্রিটেনেও তাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এর মধ্যে বাড়ি উপহার নেওয়ার খবর তাকে সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
সানডে টাইমস লিখেছে, লন্ডনে পাঁচটি বাড়ির খোঁজ মিলেছে, যেগুলো টিউলিপ ও তার পরিবারের সদস্যরা উপহার পেয়েছেন অথবা ব্যবহার করেছেন। সেসব বাড়ি তারা পেয়েছেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের যোগসূত্র আছে।
টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমর্থনের সঙ্গে এসব সম্পত্তির যোগসূত্র থাকার ধারণা ‘একেবারেই ভুল’।
তবে তার সরে যাওয়ার দাবি জোরালো হয়ে ওঠায় টিউলিপ ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর (স্ট্যান্ডার্ডস ওয়াচডগ) স্যার লাউরি ম্যাগনাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বসে সানডে টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, “টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার বিষয়টি তার ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই নয়।
“তিনি দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রী হয়েছেন এবং নিজেকে এখন নির্দোষ দাবি করছেন।”
ইউনূস বলেন, ‘আপনি (টিউলিপ) হয়ত তখন উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু এখন তো বুঝতে পারছেন। আপনার এখন বলা উচিৎ, ‘দুঃখিত, আমি তখন এটা বুঝতে পারিনি, আমি জনগণের কাছে ক্ষমা চাইছি এবং পদত্যাগ করছি। কিন্তু তিনি সেটা না বলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন।’
ইউনূস অবশ্য এটাও বলেন, টিউলিপের পদত্যাগ করা উচিৎ, এই কথা তার বলার কথা নয়।
দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়া নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে করে ইউনূস বলেন, এর কিছু অর্থ বিভিন্ন সম্পদ কেনার ক্ষেত্রেও ব্যয় হয়েছে।
‘তারা নথিতে দেখিয়েছে কত টাকা চুরি হয়েছে। কিন্তু এটা চুরি নয়। কারণ আপনি যখন চুরি করবেন, তখন সেটা লুকিয়ে রাখবেন। এটা একটা ডাকাতি,’ বলেন ইউনূস।
শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা লন্ডনে যেসব সম্পদ ব্যবহার করেছেন, সেগুলোতে ওই অর্থ ব্যয় হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউনূস বলেন, ‘অবশ্যই। এটা স্রেফ ডাকাতি। এর বাইরে কিছু নয়। যুক্তরাজ্যের কোনো পার্লামেন্ট সদস্য জড়িত থাকলে অবশ্যই এটা বড় একটা ঘটনা। আমরা (আগের সরকার) সবকিছুই কেড়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন আপনারা বিষয়টি বিশ্বের নজরে আনায় আমরা স্বস্তিবোধ করছি।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি বাংলাদেশকে একবারে কলুষিত করে ফেলেছে। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যেখানে বৈষম্যও অনেক বেশি। দুর্নীতির মাত্রা বোঝানোর ক্ষেত্রে কলুষিত শব্দটি যথেষ্ট নয়। দুর্নীতির কারণে দেশ একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। সততা কী, স্বচ্ছতা কী, তা ধরে রাখার কোনো ইচ্ছা (শেখ হাসিনা সরকারের) ছিল না। এসব ধ্বংস করার ব্যাপারে কোনো দ্বিধাও ছিল না তাদের। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা এসবই পেয়েছি।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিবিষয়ক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম, যেখানে নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া ও রাশিয়াও এতটা তলানিতে নেই।
টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পত্তির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চালানো উচিৎ কিনা জানতে চাইলে ইউনূস বলেন, ‘অবশ্যই। কমিশনের সবকিছুতেই নজর দেওয়া উচিৎ।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সহযোগীদের মাধ্যমে বাইরে চলে যাওয়া সম্পদ সম্ভব হলে দেশে ফিরিয়ে আনা উচিৎ।
‘এটা অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যও। কারণ এই টাকাটা জনগণের। আর যখন আমি বলছি ‘জনগণ’ সেটা সেসব কোটিপতিদের বোঝায় না, যাদের কথা আপনি বলছেন। এটা একেবারে সাধারণ জনগণ।’
সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান রহমানের ‘দাতব্য কর্মকাণ্ড’ নিয়েও রসিকতা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
অর্থপাচারের অভিযোগে বর্তমানে শায়ানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, যিনি যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য সংস্থায় আড়াই লাখ পাউন্ড অনুদান দিয়েছিলেন।
দুর্নীতির ঘটনা তদন্তে সহযোগিতা করতে যুক্তরাজ্য তাদের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) কর্মকর্তাদের ঢাকায় পাঠানোয় সাধুবাদ জানান ইউনূস। ওই সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ পেলে তারা যুক্তরাজ্যে যে কোনো সম্পত্তি অবরুদ্ধ করতে প্রস্তুত রয়েছে।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরতে গিয়ে ইউনূস সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে সব ধরনের প্রচেষ্টাই করা হবে।’
২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘মাঝামাঝি (২০২৬) সময়ের মধ্যে যে কোনো কিছু ঘটতেই হবে। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হলে সেটা চলতি বছরের শেষে। নির্বাচন হয়ে গেলে নতুন সরকার ক্ষমতা নেবে। নির্বাচনে আমরা কোনো পদের জন্য লড়ব না। আশা করছি আমরা ভালো করব এবং ইতিহাসের সবচেয়ে স্বচ্ছ একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারব।’