শুক্রবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ডিনস্টন সিমেট্রি: শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত শ্রীমঙ্গল

আলমগীর হোসাইন, মৌলভীবাজার : শত ব্যস্ততার মাঝে, ক্লান্তিতে, গল্প- আড্ডায়, বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে কিংবা ফুরফুরে একটি দিনের শুরুতে চা চাই-ই চাই। সময়ে-অসময়ে এককাপ চা লাগবেই— এমন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে চাপ্রেমী মানুষ আছে। একটি কুঁড়ি দুটি পাতার কী যে স্বাদ, তা জানে আজ সারা দুনিয়ার মানুষ। যেদিন থেকে চা পাতার খোঁজ মিলেছে, সেদিন থেকেই চায়ের অনন্য স্বাদ-গন্ধ একটু একটু করে আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষকেই মাতিয়ে রেখেছে। বশ করে নিয়েছে তার গুণাগুণ দিয়ে। তো, মন মাতানো এই চায়ের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র যে কত গভীর তা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও এদেশে চা চাষের শুরুর গল্পটা কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা। তাই এককাপ চায়ের সঙ্গে আজ না হয় সেই ইতিহাসটাই চলুক?

১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ১৮৫৭ সালে সিলেট বিভাগে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়।

জানা যায়, চা উৎপাদনের শুরু থেকেই ব্রিটিশরা এদেশে এসে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সিলেট, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জে চা বাগান গড়ে ওঠে । শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানে গিলবার্ড হেনরি টেট নামে এক ব্রিটিশ ‘টি প্লান্টার’ চা চাষ শুরু করেন। ওই সময় ব্রিটেনের অনেক নাগরিক পরিবার-পরিজন ব্রিটেনে রেখে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষাবাদের চাকরি সূত্রে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে আসতে থাকেন। যদিও এখন ব্রিটিশদের কেউ-ই চা উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চলে নেই, এমনকি নেই তাদের কোন প্রতিনিধিও।সেসময়ে অনেকেই এই অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেছেন, আবার কেউ চাকরি ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে গেছেন।

রাজঘাট চা বাগানে চাকরিসূত্রে এসে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে ডিনস্টন সিমেট্রিতে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ফিনলে টি কোম্পানির ডিনস্টন চা বাগান। এখানেই শত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে ডিনস্টন সিমেট্রি। ডিনস্টন চা বাগানে চাকরি করার সময় গিলবার্ড হেনরি টেট ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর মারা যান। তখন তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। স্ত্রী-ছেলে নিজ দেশে রেখে এখানে তিনি এসেছিলেন চা উৎপাদক হিসেবে। কয়েকবছর আগে গিলবার্ডের ছেলে পিটার টেট বাবার সমাধি দেখতে প্রথমবারের মতো আসেন বাংলাদেশে।

তিনি শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে বাবার সমাধি দেখার পাশাপাশি তার মায়ের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তার মৃত্যুর পর মরদেহের ভস্ম বাবার সমাধির পদপ্রান্তে রেখে গেছেন।

সুকুমার গোয়ালা নামে স্থানীয় এক চা শ্রমিক জানান, এই সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবরের সংখ্যা ৪৬। এর মধ্যে এখানে শায়িত রয়েছেন এক ব্রিটিশ দম্পতি ও ৯ জন শিশু। পাঁচটি সমাধিতে কোনো নাম পরিচয় উল্লেখ নেই। এই সিমেট্রিতে সমাহিতদের মধ্যে রয়েছেন রবার্ট রয়বেইলি নামের এক ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন_জর্জ উইলিয়াম পিটার ও মেরি এলিজাবেথ পিটার দম্পতি। ১৯১৮ সালের ১৮ মে জর্জ উইলিয়াম পিটারের সহধর্মিনী মেরি এলিজাবেথ পিটার মারা যান। অন্যদিকে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জর্জ উইলিয়াম পিটার মারা গেলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয়। এ ছাড়াও রয়েছেন এডওয়ার্ড ওয়ালেস। ১৯১৯ সালের ২০ জানুয়ারি ব্রিটিশ এই নাগরিক মারা যান। ১৯৩৭ সালের প্রথমদিকে হান্ট নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে মারা যান, তাকেও এখানে সমাহিত করা হয়েছে।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার একটি বিমান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শ্রীমঙ্গলের উদনাছড়া চা বাগানে বিধ্বস্ত হলে ওই বিমানের দুজন চালক মারা যান। এই দুজনের মরদেহও এই ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকার সামরিক বাহিনী ওই দুজনের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে নিজ দেশে নিয়ে যায়।

ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা জেমস নামে এক পর্যটক বলেন, ডিনস্টন সিমেট্রির ইতিহাস মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অনেক বিদেশি নাগরিক তাদের স্ত্রী-সন্তানকে রেখে চাকরি করতে এখানে এসেছিলেন। মৃত্যুর পর তাদের দেহ এখানেই সমাহিত করা হয়েছে। নাম পরিচয়হীন একটি সমাধিতে লেখা রয়েছে ‘In Loving Memory of my dearest husband’. এই লেখার নিচেই লেখা রয়েছে জেসিজি । জানা যায়,এই অঞ্চলে কর্মরত এক ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যুর খবর শুনে নিহতের স্ত্রী জেসিজি তাৎক্ষণিক ফ্লাইটে সুদূর ব্রিটেন থেকে শ্রীমঙ্গলে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে তার স্বামীর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়ে গেছে। তাই কফিনে খোদাই করে নিজ হাতে তিনি লিখে গেছেন এই বাক্যটি। পর্যটক ও স্থানীয়দের হৃদয় নাড়া দিতে এই লেখাটি সম্ভবত যথেষ্ট!

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ