সোমবার, ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দখল-দূষণে বিপন্ন নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী

মেহেদী হাসান, নেত্রকোনা প্রতিনিধি: নেত্রকোনা শহরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে ঐতিহ্যবাহী এই মগড়া নদী। উভয় অংশের যোগাযোগের জন্য অন্তত সাতটি সেতু আছে নেত্রকোনা জেলা শহরের ভেতরে। নেত্রকোনা শহরের এই ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদীতে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা। নদীর দুই পাড়ে জমে গেছে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। এই নদীর পাড় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ শত শত স্থাপনা। এরকম অবস্থা এই জেলার সকল নদ নদী গুলো। যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে নদীর তীরের বিভিন্ন অংশ। নেত্রকোনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে মগড়া নদী। গত চার যুগে দখলে নাব্যতা হারিয়েছে এই জেলার সকল নদ নদী। আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে এই নদী গুলোর পানি ও জীববৈচিত্র্য। একসময়ের এই জেলার প্রাণচঞ্চল কংশ, মগড়া, সোমেশ্বরী ও ধনু নদী এখন হয়ে উঠছে নিষ্প্রাণ ও অপরিচ্ছন্ন। নেত্রকোনাবাসী দীর্ঘদিন ধরে এই নদী গুলো খননের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে এই নদী গুলোর তীরে গড়ে উঠা কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া প্রশাসন আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পরিবেশবিদ সাইফুল্লাহ ইমরান বলেন, ‘যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই কংশ, মগড়া সহ জেলার সকল নদ নদী গুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন নদী গুলো যেভাবে দখল ও দূষণ হচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। এছাড়া শহরের মগড়া নদীর পানি এখন আর ব্যবহার করা যায় না। শহরে আগে ২০টির মতো স্নানের ঘাট ছিল। এখন তিন–চারটি ছাড়া বাকিগুলো দখল হয়ে গেছে। তবে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে নদীর অনেক জায়গা উদ্ধার করেছে। পাশাপাশি সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করে নদী সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হলে মগড়া নদী নেত্রকোনা শহরবাসীর জন্য আশীর্বাদ হবে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, নেত্রকোনা শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া মগড়া নদী পুনঃখনন নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে জরিপ কাজ চলছে। আর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে বাকি সকল নদ নদী গুলোর তীরে অবস্থিত সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, নেত্রকোনা শহরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে এই ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। এই নদীর উভয় অংশের যোগাযোগের জন্য অন্তত সাতটি সেতু আছে শহরের ভেতরে। এই সেতুগুলোর মধ্যে মোক্তারপাড়া সেতুটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সেতুটি শহরের প্রধান সড়ক ঢাকা ময়মনসিংহ যেতে হয়। এই জেলার সকল নদীর সব স্থানেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এমনকি পৌরসভার নালা-নর্দমার পানি ও ফেলা হচ্ছে এই মগড়া নদীতে। পাশাপাশি মাছ ধরার জন্য বাঁশের খুঁটি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদ জন্মে ডোবার মতো হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদীর চেহারা। মোক্তারপাড়া এলাকার কাজল বলেন, এই শহরের প্রাণ মগড়া নদী, এখন এই নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।এখন ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য নোংরা পরিবেশের কারণে মশা-মাছির উপদ্রব থাকে। মাঝে মধ্যে মাছ মরে ভেসে ওঠে। তিন বছর আগে প্রশাসন কিছু এলাকা দখলমুক্ত করে। সেগুলো তদারকি না করায় আবার দখল হয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনা জেলা শহরের প্রাণ ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। পাউবোর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. এনামুল হক বাংলাদেশের নদ-নদী গ্রন্থে লিখেছেন, ময়মনসিংহের ফুলপুরের ধলাই নদের দক্ষিণমুখী প্রবাহ সুয়াই নদের সঙ্গে মিলে নেত্রকোনা সদর উপজেলার রৌহা এলাকায় মগড়া নাম ধারণ করে। এরপর জেলা শহর হয়ে আটপাড়া উপজেলা ঘুরে ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদন উপজেলার বারুণী নদীতে মিলিত হয়েছে। নেত্রকোনার ভেতরে নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী (৭৫) জানান, ৫৬ বছর আগেও মগড়া প্রমত্ত ছিল। জোয়ার-ভাটা হতো। বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নদী দিয়ে বড় বড় মহাজনি নৌকা আসত। সব সময় নদীতে পালতোলা নৌকা, স্টিমার ও লঞ্চ চলত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে মোক্তারপাড়া এলাকায় পাকা সেতু নির্মাণ করার পর বড় নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও ছোট ও মাঝারি নৌকা চলত। কিন্তু চার বছর আগে এই সেতু নতুন করে নির্মাণ করা হয়। এরপর নৌ চলাচলই বন্ধ হয়ে গেছে। নির্মাণের সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা সেতু উঁচু করার জন্য বারবার দাবি জানালেও কর্মকর্তারা তা শোনেননি। পরিকল্পিতভাবে এই ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মগড়া নয় এই জেলার সকল নদ নদী গুলোর একেই হাল।

নেত্রকোনা শহরের পাটপট্টি এলাকার বাসিন্দা লিয়াকত বলেন, দখল-দূষণে মগড়া সহ এখন জেলার অনেক নদী বিপন্ন। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা নদীতে ফেলা হচ্ছে না। যাঁরা এই নদী গুলোকে হত্যা করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে মগড়া নদীর দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে ৩১৬টি অবৈধ স্থাপনার উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে বিআরএস অনুযায়ী মেপে অভিযান চালিয়ে ২৯৩টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকি ২৩টি স্থাপনা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। অভিযানে উদ্ধার হওয়া ভূমির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮০ একর। নেত্রকোনা পৌর মেয়র মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গে নদীর সম্পর্ক। নেত্রকোনা শহরই মগড়া নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। নদীটি রক্ষায় পৌরসভার পক্ষ থেকে আবর্জনা না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। নাগরা আনন্দবাজার সেতু এলাকা থেকে মোক্তারপাড়া সেতু পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, বর্তমানে নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনায় সিএস অনুযায়ী মাপার কাজ চলছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *