বিশেষ প্রতিবেদক : নবাবগঞ্জ এতিমখানা শুধু উপজেলারই নয়, জেলার মধ্যেও পরিচিত এবং ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের এতিমদের নামে চলছে হরিলুট। এতিম আছে মাত্র ১০ জন, বিল করা হচ্ছে শতাধিক এতিমের নামে। আর এভাবেই আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে যোগসাজসে সরকারি অর্থ হরিলুট করছেন সমাজসেবা কর্মকর্তা ও নবাবগঞ্জ এতিমখানার সভাপতি ইব্রাহিম খলিল।
ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্র ইছামতি নদীর কূল ঘেঁষে নবাবগঞ্জ বাজারের উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত নবাবগঞ্জ এতিমখানা ও দাখিল মাদ্রাসা।এই মাদ্রাসাটি ১৯৮২ সালে আলহাজ্ব মুহাম্মদ সেলিম চৌধুরীর অদম্য সাহসিকতা, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ জনগনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি নবাবগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসাটি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রথম অনুমতি লাভ করে। ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৬ সালের ১ ডিসেম্বর সরকারের এমপিওভুক্তির তালিকায় আসে।
এ বিষয়ে এতিমখানার সভাপতির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, অভিযোগ মিথ্যা। নবাবগঞ্জ প্রেসক্লাবের বহুদিনের সভাপতি, সমকাল পত্রিকার প্রতিনিধি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জানিয়ে তিনি প্রতিবেদককে নবাবগঞ্জ যেতে বলেন। পরে সরেজমিন এতিমখানা পরিদর্শন শেষে সভাপতির সাথে কথা বলতে ফোন দিলে তিনি প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি। একইভাবে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে ফোন দিলে তিনি প্রতিবেদকের অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং ফোনে তথ্য দেয়া যাবে না জানিয়ে নবাবগঞ্জ আসতে বলেন। পরে নবাবগঞ্জে গিয়ে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদকের কল রিসিভও করেননি।
সরেজমিন এতিমখানায় গেলে দেখা যায় সেখানে এতিম আছেন ১০ জন, বাবা-মা আছে এমন শিশুর সংখ্যা ৫০ এর অধিক, বাবা আছে মা নাই এমন শিশুর সংখ্যা ৩০ জন। এই এতিমখানার ছাত্র সায়েম (ছদ্মনাম), পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তার বাবা আছে মা নেই। দুই ভাই এক বোনের সংসারে শিশু সায়েমকে এই এতিমখানায় দিয়ে গেছে গ্রীল শ্রমিক বাবা। দু:স্থ্য হলেও শিশু সায়েম কিন্তু এতিম নয়। একইভাবে শিশু তানভীর (ছদ্মনাম) এর বয়স ১৭ বছরেরও বেশি। সে পড়ে অষ্টম শ্রেনিতে। তানভীরের বাবা ও মা উভয়েই বেঁচে আছেন। সে তাঁর এক বন্ধুর কাছে শুনে এখানে এসেছেন। এমন অনেকেই আছেন এখানে যারা দু:স্থ্য এবং অসহায়। এইখাতে আর্থিক অনিয়ম হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন খাত ওয়াইজ। এতিম, অসহায়, দু:স্থ্য- এই শিরোনামে।
তবে এতিমখানার দায়িত্বে থাকা সুপারিনটেন্ডেন্ট মো. আমিনুল ইসলাম প্রতিবেদককে জানান, তিনি এতিমখানা বিষয়ে কিছু জানেন না, নতুন এসেছেন। বেতন সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে এতিমখানা বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন না। তবে এখানে সব মিলিয়ে আড়াই শতাধিক শিশুকে সেবা দেয়া হয় বলে তিনি জেনেছেন। আরও তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, তথ্য অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পারমিশন ছাড়া তথ্য দিতে পারবেন না।
এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাজান সোহেল প্রতিবেদককে জানান, আপনি প্রতিবেদন করলে করতে পারেন। কোন তলব আসলে আমি দেখবো। এখানে কোন সমস্যা নেই।
সাধারণত আমরা এতিম বলতে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ শিশুদের বুঝি। মাতা-পিতাহীন শিশুদের এতিম বলছে বাংলা অভিধান। কিন্তু ইসলামী পরিভাষায় যে শিশুর পিতা ইন্তেকাল করেছেন কিন্তু মা বেঁচে আছেন শুধু তাদেরকে এতিম বলা হচ্ছে। ইসলামী পরিভাষাকেই এতিমের সংগা হিসেবে অভিহিত করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তরও। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেকেই তথ্য দেওয়া বিষয়ে অসহযোগিতা করায় ওয়েবসাইটের স্বরণাপন্ন হতে হয়েছে। ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বেসরকারি এতিমখানার এতিম শিশুদের জন্য ২য় কিস্ত্রি (জানুয়ারি ২০২৩- জুন ২০২৩) ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ ও মজুরি দেখানো হয়েছে এতিম ৭৩ জন, বরাদ্দ ৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এখন চলছে ২০২৪ এর মে মাস। ঢাকা জেলার সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে, কেবল নবাবগঞ্জেই রয়েছে ৫টি এতিমখানা, যেখানে এতিমের সংখ্যা উল্লেখ করা আছে ১৪৭ জন। বরাদ্দ রয়েছে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে (জানুয়ারি ২০২৩- জুন ২০২৩)। এটি কেবল এতিমদের জন্য বরাদ্দ। এর বাইরে দুঃস্থ্য এবং অসহায়দের জন্য সরকারিভাবেই ভিন্ন ভিন্ন বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়াও একটি পুরোনো এবং প্রসিদ্ধি হিসেবে এই এতিমখানায় ব্যক্তি অনুদান সবচেয়ে বেশি।