
সৈয়দ রিয়াদ মিয়া : বায়ুমণ্ডলে যে হারে কার্বন নিঃসরণ ঘটছে, এর ফলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়তো ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ডুবতে থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি শতকে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে শতকোটির ঘর। জলবায়ুর বিপর্যয় চলতে থাকলে আগামী তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন বাস্তচ্যুত হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এই তিন দশকের মধ্যে দেশে বাস্তচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সোয়া এক কোটিতে। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্তালয় প্রণীত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কোশলপত্রে এ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গত দশকে যুদ্ধ বিগ্রহের কারেণ অন্তত কয়েক কোটি মানুষ নতুন করে বাস্তচ্যুত হয়েছে। তার ওপর প্রকৃতিক দুর্যোগতো আছেই। সমগ্র পৃথিবী যখ জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যা মানুষের জীবনকে নতুন এক বাস্তবতা নিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে উত্তরণে সম্মিলিতি প্রচেষ্ঠার বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
সংঘাতের কারণে বাস্তচ্যুত মানুষের সংখ্যা এত বেড়েছে বলে মনে করতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএইচসিআর। ১০ কোটির বেশি মানুষ বাস্তচ্যুত হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের বেশি মানুষ আর নিজের ঘরে থাকতে পারছে না। এই সংখ্যার মধ্যে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও নিজের দেশেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া ৫ কোটির মতো মানুষও রয়েছে।
এটা এমন এক রেকর্ড যা কখনও না হলেই ভালো হতো, বলেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ফিলিপো গ্রান্ডি। নতুন এই সংখ্যা বিধ্বংসী সংঘাত রোধে ও নিপীড়ন বন্ধে এবং মানুষ কেন ঘর ছাড়তে বাধা হচ্ছেন তা শনাক্ত করে সমাধান খুঁজতে আমাদের কাছে এক সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করা উচিত, যোগ করেন গ্রান্ডি।
বিষয়টি সম্পর্কে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেছেন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় নদী ভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে রাজচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণে সব গ্রুপকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মেগাসিটির ধারণা থেকে সরে গিয়ে গ্রোথ সেন্টারভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে যে, ঘর ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ৯ কোটির কাছাকাছি ছিল। ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসো, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান এবং কঙ্গোতে সংঘাতের কারণে মূলত সংখ্যাটি বাড়ছিল। এর সঙ্গে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাস্তচ্যুত মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে।
বিভিন্ন হিসেবে এ পর্যন্ত ইউক্রেন ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ৭৫ লাখ মানুষ। আর অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তচ্যুত হয়েছে ৭৭ লাখ মানুষ। সেই হিসেবে সব মিলে ঘরছাড়া করেছেন ১ কোটি ৫২ লাখ মানুষ। একই রকম হিসাব দিয়েছে ইউএনএইচসিআর। তারা বলছে, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখ, আর শরনার্থী হয়েছেন ৬০ লাখ। সব মিলে ঘরছাড়া হয়েছেন ১ কোটি ৪০।
কয়েক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কোশলপত্রে উল্লেখ করা জাতীয় কোশলপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, মূল ভূখত এলাকায় বাস্তুচ্যুতি ঘটানোর মূল কারণ নদী ভাঙ্গন ও বন্যা। দেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় নিয়মিত পরা হয়। এটাও বাস্তচ্যুতি ঘটায়। ভূতাত্ত্বিকভাবে কয়েকটি সক্রিয় চ্যুতি মধ্যে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ দেশ।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে। ২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, দেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে। এর বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে, যেমন ভোলা, খুলনা ও পটুয়াখালী। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ জোয়ারের পানির উচ্চতাবৃদ্ধি, যা উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা ঘটায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দুর্যোগের এসব প্রক্রিয়ার আরও অবনতি ঘটাতে পারে। ২০৮০ সালের মধ্যে তলিয়ে করা প্রয়োজন। তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ শতাংশ ভূমি।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশ কৌশলপত্রে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে যেমন ক্ষতি হল, অভিযোজন তহবিল, জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এ জন্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে একটি বিল সংগ্রহ ও বায় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের অধীনে আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শ্রমবাজার বিবেচনায় রেখে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি জন্য অকৃষি খাতে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ অংশীদারির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।