শুক্রবার, ২৮শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,১১ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে…

গুলশাহানা ঊর্মি:

“পিতা দিলেন স্বাধীনতা,
কন্যার হাতে দেশ।
আপন আলোয় উদ্ভাসিত,
সোনার বাংলাদেশ।”

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এসে পূর্ণতা পায়, সগৌরবে-স্বাধীনভাবে যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশ ‘বাংলাদেশ’। যুদ্ধবিধ্বস্ত-ধ্বংসস্তুপসম একটি দেশের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে দিন-রাত এক করে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন তিনি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হতে না হতেই ৭৫ এ সংগঠিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত, ন্যাক্কারজনক, ঘৃণিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্টের পর মুখ থুবড়ে পড়ে সদ্যস্বাধীন দেশের সকল কর্মকাণ্ড, বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে।

জাতির পিতা’র দুইকন্যা বিদেশে অবস্থানের ফলে প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের দেশের মাটিতে আসতে দেওয়া হয় না। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আসেন তিনি, নতুন করে চলতে শুরু করে থমকে যাওয়া বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ৭৫ সালে হোঁচট খাওয়ার পর আবারো চলতে শুরু করে উন্নয়নের চাকা। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠে বিশেষ করে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষাকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘সেইফটি নেট’ কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রহণ করা হয় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ এর মতো দারিদ্র্য বিমোচনে যুগান্তকারী কর্মসূচি। বয়স্কভাতা ও বিধবাভাতার মতো কর্মসূচিগুলোর সূচনাও ঘটে এ সময়ে। তথ্য প্রযুক্তিখাতে আমদানিশুল্ক কমিয়ে তথ্য প্রযুক্তিকে জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলে, ‘ডিজিটাল যুগ’ এ প্রবেশের সূচনা হয় মূলত এর মাধ্যমেই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সাথে ‘গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি’, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর স্বীকৃতি, জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচন বিশ্ব আঙিনায় বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে নতুনভাবে উপস্থাপন করে।

২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন উদ্যোমে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের প্রয়াশে নতুন আঙ্গিকে কাজ শুরু হয়। জাতির পিতার রক্ত-আদর্শের উত্তরসূরি, তাঁর সুযোগ্যকন্যা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একযুগের অধিক মেয়াদে পরিচালিত হচ্ছে দেশ। ইতোমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করতে পেরেছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে আমাদের অগ্রগতি বিস্ময়কর।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে গেছে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিখাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সারাদেশে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। এসব বাস্তবায়ন হলে কর্মসংস্থান তৈরিসহ আমাদের অর্থনীতিতে আরো গতি সঞ্চার হবে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট। ইতোমধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বের কাছে আমাদের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে।

‘মুজিববর্ষ’ এর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন ‘মুজিববর্ষে বাংলার মাটিতে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর সারাদেশে ভূমিহীন,গৃহহীন, অসহায় নিরাশ্রয়, নিরন্ন মানুষের প্রাণে উৎসব লাগে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা কথা দিলে কথা রাখেন’। তাঁরা আশায় বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নিজেদের একটা স্থায়ী আবাস্থলের, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের। বিশ্বব্যাপী করোনার অতিমারীর কারণে মুজিববর্ষের শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায় মুজিববর্ষে গৃহীত নানা আনুষ্ঠানিকতা, স্থিমিত হয়ে যায় উৎসব-আনন্দ কিন্তু থেমে থাকে না প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ। করোনা অতিমারীর কারণে সময় বাড়ানো হয় মুজিববর্ষের। বর্ধিত সময়ের পুরোটা জুড়েই চলে গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ ও বিতরণের কাজ। মুজিববর্ষের পুরোটা সময় জুড়ে সারাদেশের নিরাশ্রয় অসহায় মানুষের মুখে লেগে থাকে আনন্দের হাসি।

‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ এর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুবিধাবঞ্চিত, ভূমিহীন এবং গৃহহীন মানুষকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে একীভূত করছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য দেশের ৬৪টি জেলার ভূমিহীন ও গৃহহীন ব্যক্তিদের তালিকা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত মানুষ, জাতিগত গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, দলিত, হরিজন এবং অন্যান্য সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায় এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির তত্ত্বাবধানে তালিকায় সংযোজন বা কর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

‘আশ্রয়ণ’ বলতে শুধুমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়াই বোঝায় না, এর সাথে যুক্ত হয়েছে সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের অন্যান্য অনুসঙ্গ। সুবিধাভোগীরা দুই ডেসিমেল জমির মালিকানার পাশাপাশি একটি রান্নাঘর, একটি বাথরুম, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগসহ একটি দুই রুমের বাড়ি পেয়েছেন। বাড়ি ও জমির মালিকানা যৌথভাবে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের নামেই নথিভুক্ত। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতি দশটি পরিবারের জন্য পানীয় জলের জন্য একটি করে নলকূপ রয়েছে। তাদের চিকিৎসার প্রয়োজনে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় বাচ্চাদের এবং কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক কার্যকলাপ এবং বিনোদনের জন্য একটি খেলার মাঠও রয়েছে। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রামের সমস্ত প্রয়োজনীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আশ্রয়ণ প্রকল্পে রয়েছে যাতে করে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা যায়, কেননা বঙ্গবন্ধুকন্যা বিশ্বাস করেন দেশের বিশাল একটি অংশকে পিছিয়ে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ বিশ্বের প্রথম এবং বৃহত্তম প্রকল্প যা রাষ্ট্রের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মূলধারার সমাজে একীভূত করেছে।

টানা তিন মেয়াদে সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবনমান উন্নয়ন বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত, নিরন্ন, অসহায় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা। জাতির পিতার মতো তাঁর কন্যাও এই দেশের মানুষকে জীবনটা দিয়ে ভালবাসেন। এই দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়েই যেন ৭৫ সালে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা বিলাসিতাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন এই দেশের মানুষের জন্য।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিয়েছেন যা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশ এক অদম্য চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা যখন ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বঙ্গবন্ধুকন্যার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গত সাড়ে ১৩ বছরে এই সংখ্যাটি ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। যেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন আমার উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লিখাব।

আগামীকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর নিরোগ ও দীর্ঘজীবন কামনা করে দোয়া করছি। তিনি ভাল থাকলেই ভাল থাকবে এই দেশের মানুষ। জাতির পিতার পরেই তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই দেশকে এবং দেশের মানুষকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। এই দেশের প্রতিটি মানুষের খবর তিনি রাখেন এবং তাঁদের দুঃখ-দুর্দশায় আপনজনের মতো করে আগলে রাখেন।

লেখক,
গুলশাহানা ঊর্মি
বিসিএস তথ্য
প্রেস উইং, প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ