
সাদাফ মেহেদী, পবিপ্রবি: একটা সময় প্রশাসনের রোষনলে পড়ে হারিয়েছেন চাকরি। দীর্ঘ ১০ বছর পর ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের সুবাদে চাকরি ফিরে পেয়েছেন। সাথে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন ৯৫ লক্ষ টাকা। হয়েছেন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পেয়েছেন ছাত্র বিষয়ক উপ-উপদেষ্টার পদবী। পেয়েছেন বিএনসিসির মত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের দায়িত্ব। এতকিছুর পরও সন্তুষ্ট নন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. এবিএম সাইফুল ইসলাম।
সাম্প্রতিক তার আচরণবিধি ও স্বেচ্ছাচারিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একাডেমিক কাজে মনোনিবেশের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি হতে শুরু করে প্রশাসনিক চেয়ার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান একাই। প্রয়োজনে ব্যবহার করেন গত ফ্যাসিবাদী আমলে মাজলুম থাকার গল্প। সামনে আনেন বিএনপিপন্থি শিক্ষক ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পবিপ্রবি ইউট্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক এর মত বড় রাজনৈতিক পরিচয়।
সহিংসতা ছড়িয়ে করতে চান আধিপত্য বিস্তার। অর্জন করতে চান ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার মত গুরুত্বপূর্ণ পদবী। ক্রমান্বয়ে আরো অনেক কিছু।
সাম্প্রতিক পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইকোনমিক্স এন্ড সোসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: সুজাহাঙ্গির কবির সরকারকে।
এতে নাখোশ হয়ে ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে ড. এবিএম সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আগের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে এ পদ ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে গেছেন এবিএম সাইফুল। কার্যালয়ে তালা লাগানোর কথা স্বীকার করে সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল বলেন, “ড. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর আমি নিজ উদ্যোগে নিজস্ব একটি তালা পরিচালকের কক্ষে লাগিয়ে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি কোনো ইনভেন্টরি কমিটি গঠন করে, আমি কেবল ওই কমিটির কাছেই চাবি হস্তান্তর করব।”
গত ৪ঠা আগস্ট রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মো: ইকতিয়ার উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে প্রফেসর ড. মো: সুজাহাঙ্গির কবির সরকারকে ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা করলে এতে আরো সহিংস হয়ে উঠেন সহযোগী অধ্যাপক এবিএম সাইফুল।
প্রশাসন জামাতিকরণ করা হচ্ছে বলে দাবি তুলে গত ৬ই আগস্ট পদত্যাগ করেন ছাত্র বিষয়ক উপ-উপদেষ্টার পদ থেকে। সামনে আনেন গত ফ্যাসিবাদী আমলে জুলুমের শিকার হওয়ার গল্প।
একই সাথে রাজনৈতিক পরিচয়েও এ পদবি তিনি প্রাপ্য বলে দাবি করেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অধ্যাপক সুজাহাঙ্গীর গ্রেড-২-এর অধ্যাপক এবং দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি, পোস্ট-ডক ডিগ্রিধারী। অপরদিকে সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল গ্রেড-৪-এর সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
সাম্প্রতিক এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, “প্রশাসন জামাতীকরণ করার প্রতিবাদে আমি পদত্যাগ করেছি। জামাতের শিক্ষকদের নীতি আদর্শের সাথে ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার দপ্তর যায় না।”
জামাতীকরণের অভিযোগ অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বড় ২৮টি পদের ২৩টিতে বিএনপি পন্থী এবং ৫টিতে জামাত পন্থী শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন।
শুধুমাত্র নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে এমন অভিযোগ তুলেছেন বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর কাজী রফিকুল ইসলামের। ইতিপূর্বে এবিএম সাইফুল জামাত পন্থী শিক্ষক, সাবেক ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার দপ্তরে স্বাচ্ছন্দে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা যায়।
তার এমন সহিংস আচরণে বিক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। অনেকের মতে নিজের পদ লালসায় শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে শিক্ষার মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করছেন প্রফেসর এবিএম সাইফুল ইসলাম। তার এমন আচরণে বিএনপি পন্থী অনেক শিক্ষকরাও বিব্রত।
এমনকি ফেসবুকে অন্য বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ও জামাত ট্যাগ দেওয়ার ছবিও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এছাড়া গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে আসেন তিনি, এই ৩৬৫ দিনে তিনি শুধুমাত্র ২৩-২৪ সেশনের একটি কোর্সে কোর্স টিচার হিসেবে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, সেই কোর্সেও মাত্র ২ টি ক্লাস নিয়েছেন। যা কিনা শিক্ষকতা পেশার জন্য চরম অবমাননাকর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এস এম হেমায়েত জাহান বলেন, “এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। আমরা জামাত-বিএনপি পন্থী শিক্ষকরা একসাথে কাজ করছি। গণভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা ঐক্য ধরে রাখার বিষয়ে অনড়।”
বিএনপি পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি প্রফেসর ড. মামুন অর রশিদ বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো বিভাজন হবে না। আমরা (জামাত+বিএনপি পন্থী) একসাথে আছি।”
কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী হুসাইন আল মামুন বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষকদের এমন দখলদারি মনোভাব আমাদের ভাবাচ্ছে। শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রগতির দিকে লক্ষ্য না রেখে পদ দখলের প্রতিযোগিতা দুঃখজনক।”
সাবেক শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান বলেন, “জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে এমন আগ্রাসন চরম হতাশাজনক।শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় আমলে না এনে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণা এবং দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষকদের পদায়ন করেছি। কারো স্বার্থচরিতার্থের লক্ষ্যে এমন হীন কর্মকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তিনি আরও বলেন, সে যদি এমন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে তবে সরকারি বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”