শাহ ইমরান, কুমিল্লা: পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এটি সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বর্তমানে দেখা গেছে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান করে নিয়েছে। সবজি, মাছ, তরি-তরকারি কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা পলিথিন ব্যবহার করছি। অনেক সময় কাগজের ব্যাগ কিংবা পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও প্রতিনিয়ত পলিথিন ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ায় আমরা সেই পথে এগোতে পারছি না।
বিশেষ করে শহরের মানুষ থলি ব্যবহার না করায় পলিথিনের ওপর অধিক নির্ভরশীল। কারণ গ্রামের মানুষ কাঁচাবাজার বা মুদি মালামাল কিনতে সব সময় একই থলি বা ব্যাগ ব্যবহার করে। পাশাপাশি দেখা গেছে, শহরের অধিকাংশ পরিবার খাদ্যদ্রব্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ফ্রিজে রাখে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, পলিথিন মোড়ানো খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করলে খাদ্যদ্রব্য এক ধরনের অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে। এর ফলে আমরা মারাত্মক চর্মরোগসহ ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি।
এ ছাড়া বর্তমানে আমাদের অসচেতনতার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্লাস্টিকদূষণের নতুন নতুন উৎস তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে এই দূষণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে জেলেদের ফেলে দেওয়া ও হারিয়ে যাওয়া নাইলনের জাল। এগুলো একদিকে যেমন নদীর পানিকে বিষিয়ে তুলছে সঙ্গে মাছের পেটে যাচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের বিধান করেছিল। হাইকোর্ট একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন এবং প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে সেটি কিছুদিনের বেশি কার্যকর হয়নি। এর পেছনে আমাদের অসচেতনতা, প্রশাসনের গাফিলতি আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মূল কারণ ছিল। মাঝে মাঝে দেখি বাজারে ভ্রামম্যাণ আদালত পরিচালনা হচ্ছে এতে কিছু দোকানদারকে জরিমানা করা হচ্ছে। আবার অনেক দিন ধরে বাজারে ইচ্ছামতো পলিথিন ব্যবহার করা হলেও সেদিকে প্রশাসনের কোনো নজর নেই। যে কারণে পরবর্তী সময়ে আবার যা তাই হয়ে যাচ্ছে। পলিথিনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বাজার।
পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অধিকাংশ মানুষ এখনো অজ্ঞ রয়েছি। এটি পচনশীল না হওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতি করছে। আর আমরা পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা না করেই যথেচ্ছভাবে এটি ব্যবহার করে যাচ্ছি। বিশেষ করে বর্তমানে দেশে পিলিথিনের অতি মাত্রায় ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।
এগুলো সরাসরি মাটি ও পানিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। ফলে তা মাটি ও পানির জৈব গুণ নষ্ট করছে। একই সঙ্গে তা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে। এটি এমন একটি পদার্থ যার আয়ুষ্কাল হাজার হাজার বছর। এটিকে আমরা যখন ব্যবহার করে মাটিতে বা পানিতে ফেলছি তখন এটি মাটি বা পানির সঙ্গে মিশতে পারে না। ফলে মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়।
পরিবেশবিদরা বলেন, বিশেষ করে বর্তমানে পলিথিনের পাশাপাশি ওয়ানটাইম বোতল, প্লেট, চামচ, কাপ সামগ্রী ব্যবহারে মানুষ ঝুঁকে গেছে। এগুলোর প্রতি এখনই দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের পাটশিল্পের দিকে সুনজর দিতে হবে। উৎকৃষ্ট মানের পাটের অন্যতম উৎপাদক হিসেবে বাংলাদেশ পাটের সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার হ্রাস করতে পারে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে মাঝে মধ্যে এর বিরুদ্ধে অভিযান চালালে হবে না। এটা নিয়মমাফিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। যেখান থেকে পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে সেসব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে কাগজের প্যাকেট আর পাট ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে টিভি বা পত্রিকায় পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনও করা যেতে পারে। সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্তত নিজেদের জন্য হলেও আমাদের আরো সচেতন হয়ে উঠতে হবে এবং পলিথিনমুক্ত সমাজ গড়তে কাগজের প্যাকট বা পাটের ব্যাগের দিকে নজর দিতে হবে।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজিব বলেন, পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনের বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করছি। হাজার হাজার মামলা হচ্ছে, জরিমানা হয়েছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ ও ধ্বংস করা হচ্ছে। পলিথিনের ব্যবহার নিরুৎসাহ করার জন্য জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আমাদের অভিযান চলমান এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে।