শুক্রবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পড়ি বই গড়ি দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী: শহীদের রক্তস্নাত বাংলা ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন থেকে শুরু হলো বইপ্রেমী বাঙালির প্রাণের স্পন্দন অমর একুশের বইমেলা। প্রায় পুরো বিশ্বকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত করার পর বইমেলায় গত কয়েক বছর ছন্দপতন ঘটে। করোনা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এবারের মেলা চিরায়ত রূপ পাবে- এমন প্রত্যাশা লেখক, কবি, পাঠক, প্রকাশকদের। এবারের মেলাকে ঘিরে তাই বাড়তি উচ্ছ্বাস সবার, যেন করোনাকালিন সময়গুলো পুষিয়ে নেওয়া যায়।

বইমেলা বাঙালির মননশীল চর্চার ধারাকে বেগবান করতে প্রতি বছর আয়োজিত হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে দেশে মননশীলতার চর্চায় যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, একে এগিয়ে নিতে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার, তা কর্তৃপক্ষ, লেখক, প্রকাশকসহ সবার কতোটা থাকে, আমাদের ঘাটতি কোথায়, এসব বিষয়ে নজর দেওয়া খুব জরুরি বলে আমরা মনে করি।

একুশের বইমেলা বলে প্রথমেই আসে বইয়ের প্রসঙ্গ। মানসম্মত, রুচিশীল বই মানুষকে উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষা দেয়। সৃজনশীল বই সব বয়সের মানুষের শুদ্ধ মননের আয়না। যে আয়নায় নিজের ছবি ধরা পড়ে, তখন নিজেকে গড়া যায়। মননশীল বই প্রকাশ আর নানা প্রজন্মকে বইমুখী করে তোলে চিন্তাশীল সমাজ গঠনের উদাহরণ বিভিন্ন দেশে আছে। আমরা কি তেমন চিন্তাশীল সমাজ গড়ার দিকে হাঁটছি? পাঠকের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন ও রুচিবোধ উন্নত করার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি চেতনায় নাড়া দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত বই কি একুশের মেলায় প্রকাশ পায়?

বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃত ইতিহাস জানানো, চিন্তাভাবনাকে শাণিত করা ও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তোলার মতো মনশীল বই যেগুলো প্রকাশিত হয়, সেগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছানোর মতো ব্যবস্থাও নেই। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য, তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ বইবিমুখ। তারা পড়তে, জানতে বেশ অনাগ্রহী। বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস চর্চার বদলে তাদের মেধা, মন কম্পিউটারের ভাইরাসে সীমাবদ্ধ। এমন আত্মঘাতী অবস্থা থেকে তাদেরকে উত্তরণের উপায় নিয়ে যথাযথ ভাবনাচিন্তা অনেকের মধ্যে দেখা যায় না।

এবারের একুশের বইমেলার শ্লোগান ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। সময়োপযোগী শ্লোগান। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এ দেশ তাঁর অসাম্প্রদায়িক আদর্শ, চিন্তা-চেতনায় গড়ে তোলতে হবে। জাতিকে এগিয়ে যেতে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ, রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ভাবনা সম্পর্কে সঠিক ও বস্তনিষ্ঠ চর্চা না থাকলে সেগুলোকে মন, মনন ও প্রতিদিনের জীবনে ধারণ করা সম্ভব নয়। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে তাঁর লেখা বইগুলো পড়তে হবে। তাঁর ভাষণ, বাণীগুলো পড়তে হবে। তাঁকে নিয়ে লেখা বিশিষ্টজনদের বই পড়তে হবে। রাষ্ট্রপিতার জীবনাদর্শকে সঠিকভাবে ধারণ করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। তাঁর আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় যেভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, এ উচ্চতা হিমালয়সম শিখরে পৌঁছে দিতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের আলোকিত জীবনের উপকরণ বই। মানুষকে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও সমৃদ্ধ করে বই। সমৃদ্ধ মানুষেরাই দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারেন।

কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের চর্চা না থাকলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তেমন অর্থবহ হয় না। আমাদের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থবহ করতে পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে উন্নত মূল্যবোধের চিন্তাশীল সমাজ গঠনে আরো উদ্যোগী হতে হবে। না হলে বাঙালির সংস্কৃতির শত্রুপক্ষ ও পরাজিত অপশক্তি সমাজকে গ্রাস করবে।

১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া একমাসের বইমেলার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর তনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা সাহিত্যের সব বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্য যথাযথ অনুবাদ ও প্রচারের অভাবে বিশ্বে পিছিয়ে পড়ছে। ইংরেজি ভাষায় কিছু অনুদিত হলেও প্রভাবশালী অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হয় না বললেও চলে।

বিশ্বকবি ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ওই পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার মাত্র তেরো বছরের মধ্যে। এরপর কেটে গেছে শত বছরের বেশি। এতো বছরের মধ্যেও আর বাংলা ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার আসেনি। এমনকি বৈশ্বিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ কোনো পুরস্কারও বাংলা সাহিত্যের কেউ পাননি। এর জন্য অনুবাদের দিক থেকে বিশ্ব পরিসরে বাংলা সাহিত্যের পিছিয়ে থাকাকে বিশেষ কারণ হিসেবে মনে করে থাকেন গবেষকরা।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে কোনো অপসংস্কৃতি যেন আঘাত হানতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব সবার। শুধু পুলিশের নজরদারি বা কর্তৃপক্ষের সতর্কতা- এ ধরনের মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। প্রাণের মেলা প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরে উঠুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা,
উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক যায়যায়কাল।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ