
বিশেষ প্রতিবেদক : অর্থ আর পেশী শক্তির জোরে আবাসিক এলাকায় চলছে পরিবেশ ও শব্দ দূষণকারী প্রতিষ্ঠান হামিম প্লাস্টিক রিসাইকেলের কর্মযজ্ঞ। পুরনো মেশিনারিজে চলছে কারখানার কাজ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানি লাইসেন্সেও জালিয়াতি রয়েছে। কারখানা (বাণিজ্যিক) হওয়া স্বত্বেও পানি, বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হয়েছে আবাসিকের। এছাড়া রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সার্টিফিকেট দেখিয়েছেন এখানে কর্মরত সুপারভাইজার, কিন্ত সেই কাগজেও গরমিলের প্রমাণ পেয়েছে প্রতিবেদক। দুই দফা কারখানায় গিয়েও হামিম রিসাইকেলের প্রতিষ্ঠাতা হেলাল সরদারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। ফোনেও প্রতিবেদককে ব্লক করে দেন হেলাল সরদার।
এদিকে প্রতিবার কারখানায় পাওয়া গেছে আজিজুল ইসলাম নামের একজনকে। তিনি এই কারখানায় কাজ করেন বলে দাবি করেন। কিন্তু উপরোক্ত কোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি প্রতিবেদককে দিতে পারেননি। অন্যদিকে শুভাঢ্যার চেয়ারম্যান একাধিকবার সিলগালা করার পরও কেবল টাকা দিয়ে প্রশাসনকে পকেটস্থ করেছেন হামিম প্লাস্টিক রিসাইকেলের প্রতিষ্ঠাতা হেলাল সরদার। অন্যদিকে, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাজী ইকবাল হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, আমি নিজে এই কারখানা তালাবন্ধ করে দিয়ে আসছি। তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আবার সেই তালা খুলে ফেলছে। তাদের জন্য আমার এলাকা ধূষিত হচ্ছে। আমি এই কারখানার বিরুদ্ধে শিগগিরই মানববন্ধন করবো। যা প্রয়োজন হয়, তার সবই করবো আমি।
তিনি বলেন, ঢাকার সব সাংবাদিকদের ডেকে এনে দেখাবো এই একটি কারখানার জন্য আমার ইউনিয়নের কি দশা হয়েছে। আর কতটা ঝুঁকিতে আছে এলাকাবাসী। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হামিম প্লাস্টিক রিসাইকেলের বিষয়ে ঊর্ধ্বতনদের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করবো।
এদিকে খেজুরবাগ ওয়ার্ড কমিশনার আজিজুল হকের সাথে কথা বললে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের ঘনিষ্টজন পরিচয় দিয়ে বছরের পর বছর তিনি এই অপকর্ম করে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর জীবন ঝুঁকিতে পরে, এমন কোনো কাজ আমরা আর সহ্য করবো না। এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও প্রতিবেদককে জানান তিনি। অন্যদিকে, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি প্রতিবেদককে জানান, কোনো আবাসিক এলাকায় কারখানা থাকতে পারবে না। সে আমার ভাইয়ের হোক আর আত্মীয়ের হোক। আমি মালিককে ডাকবো।
শ্রমিক শোষণ ও শিশু শ্রমের ভিডিও পাঠিয়ে প্রশ্ন করলে শ্রম সচিব মাহবুবুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, সহসাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ প্রতিবেদককে বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়, আমি দেখে তারপর ব্যবস্থা নেবো।
প্রতিষ্ঠানের মালিক হেলাল সরদার দীর্ঘদিন ছিলেন জাপানে। সেখান থেকে আমদানীর পরিবর্তে স্থাণীয়ভাবে পুরাতন মেশিনারিজ ক্রয় করে চালু করেন ঝুঁকিপূর্ণ এই কারখানার কাজ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানি লাইসেন্সেও করেছেন জালিয়াতি। কর ফাঁকি দিচ্ছেন কয়েক কোটি টাকা। তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন রপ্তানি লাইসেন্স নেয়ার।
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের খেজুরবাগের ৬ গ্রামে প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের বাস। সড়কে হাঁটু সমান কাদামাটি ও ময়লা জমেই থাকে। ময়লা আবর্জনার স্তূপের কারণে সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম । খেজুরবাগ, মুহুরীপট্টি, পারগেণ্ডরিয়া, সাতপাখি, মুসলিমনগর কানাপট্টি এলাকার মতো ঘনবসতি এলাকায় দেদারছে চলছে হামিম রিসাইকেল এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা।
অথচ কারখানার বর্জ্যের পানিতে ভরে গেছে রাস্তা-ঘাট, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া স্বত্তেও আবাসিক এলাকায় কারখানার অবস্থান হওয়ায় কারখানাটি বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে আবাসিকের রেটে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। একইভাবে কারখানার ভিতরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শব্দ দূষণসহ প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন ২০ জন কর্মী বলে জানিয়েছেন হামিম রিসাইকেলের সুপারভাইজার মোবারক হোসেন। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, এখানে সকাল ৯টায় কাজ শুরু হয়, চলে রাত ১০টা পযন্ত চলে। এখানে বেতন নিয়মিত দেয়, ইদে বোনাস দেয় কিন্তু স্বাস্থ্য ভাতা, ঝুঁকি ভাতা এবং গ্রাচুইটি টাইপ কোন সুবিধা নাই। কেউ অসুস্থ্য হলে মালিক খুশি হয়ে যা দেয়, তাই। তাও সবাইকে দেয় না বলে জানান মোবারক হোসেন।
কারখানা ঘুরে দেখা গেলো পুরোনো সব মেশিনে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের কাজ করছেন অদক্ষ শ্রমিকরা। এখানে কর্মরত কোন শ্রমিকের এসব কাজ করার আগে কোন অভিজ্ঞতাই নেই। ৭-৮ বছরের এক শিশুসহ একাধিক কিশোরকে এই কারখানায় কাজ করতে দেখা গেছে। তাদের প্রত্যেকের বেতন ১০ হাজার মাত্র এবং প্রত্যেককেই কাজ করতে হয় সকাল ৯টা থেকে, তবে কাজ শেষ হওয়ার টাইম নির্দ্রিষ্ট নেই।
অথচ এই কারখানাকেই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ১০%। জনগণের টাকায় ভর্তুকি নিয়ে চালাচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ এ কারখানা। এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে প্রতিষ্ঠাতা হেলাল সরদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন আপনার সাথে যোগাযোগ করা হবে। এরপর আজিজ নামে দিয়ে একজন প্রতিবেদককে ফোন দেন। তিনি নিজেকে সাংবাদিক দাবি করে প্রতিবেদনটি না করার অনুরোধ করেন। পরে কারখানা পরিদর্শনে গেলেও হামিম রিসাইকেলের মালিক হেলাল সরকারের সাথে প্রতিবেদকের দেখা হয় নাই। মুঠোফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে বারবার ফোন করে, ম্যাসেজ দিয়েও কোন রিপ্লাই পাওয়া যায় নি।
এদিকে, কারখানা পরিদর্শনের সময় সুপারভাইজার মোবারক পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সার্টিফিকেট দেখান তাতে প্রদানের তারিখ উল্লেখ আছে ২৬/১০/২৩। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ছাড়পত্র নিতে হেলাল সরদার ব্যয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। আবাসিক এলাকায় এই কারখানা দ্রুত অন্যন্ত্র সরিয়ে নেবেন বলেও বছরের পর বছর এখানেই আছেন তিনি। এই স্থানটি তার নিজের হওয়ায় ব্যাপক প্রভাব আছে তার।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মামুন (ছদ্মনাম) বলেন, হেলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে লাভ নাই। হেলালের প্রচুর টাকা। কোন অফিসার আসলে দোতলায় নিয়ে লাখ লাখ টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দেন এবং তাৎক্ষনিক বিষয়টি ধামাচাপা দেন। এই কারখানা পাহাড়ায় কিছু বখাটেকেও মাসোহারা দেন হেলাল। অর্থ আর পেশি শক্তির জোরে হামিম প্লাস্টিক রিসাইকেলে শ্রমিকদেরও শোষন করছেন হেলাল সরদার।
পুরোনো মেশিনারিজে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে কাজ করায়, জীবনের ঝুঁকিতে আছেন এলাকার প্রায় তিন লাখ মানুষ। দুর্ঘটনা না ঘটা অব্দি আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে চাই না, উল্টো হেলালের মতো প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে সুবিধা নিয়ে চুপ করে থাকি- বলছিলেন খেজুরবাগের স্থায়ী বাসিন্দা মনোয়ার (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, হেলালের কাছে ৪০০ কোটিরও বেশি টাকা আছে, নতুন করে আরেকটি ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনাও চলছে। সরকারি দপ্তরে ঘুষ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে হাজির হবেন হেলাল সরকার- যোগ করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানির কোন লাইসেন্সই তার নাই। জাল লাইসেন্সে চলছে হামিম প্লাস্টিক রিসাইকেলের কাজ। করও ফাঁকি দিচ্ছেন নিয়মিত। পানির সংযোগ নিয়েছেন আবাসিক এলাকা হিসেবে। অথচ এটি ফুল ফেজের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সাধারণত নতুন মেশিনারিজ ক্রয় করে এসব কারখানায় কাজ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু হামিম রিসাইকেলের কারখানায় প্রতিস্থাপিত প্রতিটি মেশিনারিজ পুরোনো। মেশিনারিজ আমদানির লাইসেন্সেও বৈধতা নেই বলে প্রতিবেদকের কাছে প্রমাণ রয়েছে।