শনিবার, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাওনা টাকার জন্য গৃহবধূকে গণধর্ষণ, বিষপানে আত্মহত্যা

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় ধার নেওয়া ২০ হাজার টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় এক গৃহবধূকে দুই মাস ধরে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করে বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগী গৃহবধূ ও তার স্বামী বিষপান করেন। এতে স্বামী বেঁচে গেলেও ওই গৃহবধূ মারা যান। ওই দম্পতির তিন বছরের একটি শিশুসন্তান রয়েছে।

রাজীবপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নে গত ২৪ মে ওই গৃহবধূ বিষপান করেন। দুটি হাসপাতাল ঘুরে পাঁচ দিন পর গত বুধবার দুপুরে বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে ২২ মে স্থানীয় এক সাংবাদিককে দেওয়া গৃহবধূর অভিযোগের একটি অডিও রেকর্ড এ প্রতিবেদকের হাতে আসে।

অডিওতে পাওনা টাকার জন্য উপজেলা সদরের হলোপাড়া গ্রামের জয়নাল মিয়া, তার সহযোগী শুক্কুর ও সোলেমানের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করেন ওই গৃহবধূ। ২০ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিওতে গৃহবধূ নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পেশায় কসাইয়ের কাজ করেন। রাজীবপুর বাজারে তাদের মাংসের দোকান আছে।

অডিওতে গৃহবধূ উল্লেখ করেন, তার স্বামী দিনমজুরির কাজের জন্য টাঙ্গাইলে থাকেন। কয়েক মাস আগে অভাবের কারণে তার স্বামী অভিযুক্ত জয়নালের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করেন। ওই টাকার জন্য জয়নাল তাকে (গৃহবধূ) চাপ দিয়ে আসছিলেন। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় জয়নাল তাকে শারীরিক সম্পর্কের কুপ্রস্তাব দেন। গত রোজার মাস থেকে তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করেন জয়নাল। একপর্যায়ে জয়নালের সহযোগী সোলেমান মুঠোফোনে জয়নালের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করেন এবং তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। এরপর জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমান দিনের পর দিন ওই গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করতে থাকেন। স্বামী বাড়িতে ফিরলে তাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানান তিনি। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ দিলেও কেউ বিচার করেননি।

গৃহবধূর স্বামী বলেন, টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি দেখেন, স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। জিজ্ঞাসা করলে জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমানের ধর্ষণের ঘটনা খুলে বলেন স্ত্রী। ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন তারা। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও দূরসম্পর্কের এক মামাকে জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানায় পৌঁছানোর আগেই রাজীবপুর ইসলামী ব্যাংকের সামনে পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ইসলাম, আমেজ উদ্দিন ও জয়নাল পথরোধ করে বাসায় ফিরে যেতে বলেন এবং রাতে বাড়িতে গিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন।

গৃহবধূর স্বামী বলেন, ‘আমরা বাসায় ফিরে এলে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাতে কনস্টেবল রবিউল, (পুলিশের) গাড়িচালক মোজাহারুল ইসলাম, জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর আমার বাড়িতে আসেন। তারা আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে চান এবং বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। আমি টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে তারা কোনো সমাধান না দিয়ে চলে যান। সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ায় শুক্রবার (২৪ মে) বিকেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী আত্মহত্যার জন্য বিষ খাই।’

গৃহবধূর স্বামী অভিযোগ করেন, গত বুধবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ও আমেজ উদ্দিন তার বাড়িতে আসেন। তখন শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। তারা তার কাছ থেকে চিকিৎসার খরচের জন্য এক লাখ টাকা দাবি করেন এবং একটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে তার পরিবারের পক্ষে কেউ টাকা দিয়েছেন কি না, তিনি জানেন না।

ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইউপি সদস্য আনোয়ার। তিনি বলেন, ওই গৃহবধূ ও তার স্বামীর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। সেই খরচ বাবদ এক লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কেন স্ট্যাম্পে চিকিৎসার খরচের বিষয়টি লেখা ছিল না জানতে চাইলে ওই ইউপি সদস্য চুপ করে থাকেন।

ঘটনার ব্যাপারে শুক্রবার রাজীবপুরের ওই ইউনিয়নে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত শুক্রবার বিকেলে ওই গৃহবধূ ও তার স্বামী বিচার না পেয়ে বিষপান করেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাদের প্রথমে রাজীবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের খরচের টাকা না থাকায় অসুস্থ অবস্থায় ওই দম্পতি বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর গত বুধবার ওই গৃহবধূ মারা যান।

অভিযুক্ত জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের বাড়ি বা মাংসের দোকানে গিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে জয়নাল ও সোলেমানের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযুক্ত আমেজ উদ্দিন ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের পাওয়া গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। স্বজনদের কাছে তার মুঠোফোন নম্বর চাইলে তারা দিতে অস্বীকৃতি জানান।

রাজীবপুর থানায় গিয়ে কনস্টেবল রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত জয়নালের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। জয়নাল একজনের কাছে টাকা পাবেন বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে ওই গৃহবধূর বাড়িতে যান। তিনি ওই বাড়িতে গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন। পরে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন।

রাজীবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত ধর্ষণের কোনো অভিযোগ পাননি। স্বামী-স্ত্রী বিষপান করেছিলেন। এর মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

কনস্টেবল ও গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ওসি বলেন, ‘জয়নাল একজনের কাছে টাকা পান, সেটি তুলতে যাওয়ার কথা বলে মোজাহারুলকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুরো পুলিশ প্রশাসন নেবে না। যদি কোনো পুলিশ সদস্য ওই গৃহবধূর বাড়িতে কোনো অপরাধে জড়িত থাকেন, তার দায় সেই সদস্যের।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

, , বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *