কামরুল হাসান, ভুজপুর (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুইটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছে আরও একজন।
উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মধ্যে দিয়ে দিন-রাত পার করছেন এলাকাবাসী। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতটি ছিল বন্যার ভয়াবহ রূপ।
স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় উপজেলাজুড়ে বন্যাদুর্গত মানুষের বাঁচার আকুতি, হাহাকার, আতংকে ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে উপজেলার বাইরের স্বেচ্ছাসেবী ও মানবিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ বিতরণে উপজেলা প্রশাসন, আইন শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি এসব সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে মানুষের জানমালের অনেক ক্ষতি রোধ করা গেছে বলে সচেতন মহলের ধারণা।
জানা গেছে, বুধবার থেকে উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী বাগানবাজার,দাঁতমারা ইউনিয়নসহ ফটিকছড়ি পৌরসভা, নাজিরহাট পৌরসভা, সুন্দরপুর, পাইন্দং ,হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, নারায়ণহাট, ভূজপুরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এছাড়া লেলাং,সমিতিরহাট, রোসাংগিরী, জাফতনগর, বক্তপুর, নানুপুর, ধর্মপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বন্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক পরিবারকে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসে। এখনো পানিবন্দী রয়েছে শত শত পরিবার। শত শত বাড়ি-ঘর পানির নিচে। খাবার, ওষুধ ও পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে এসব এলাকায়।
ভয়াবহ বন্যায় এশিয়া মহাদেশের অন্যতম আধ্যাত্মিক কেন্দ্র মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক, গহিরা-হেঁয়াকো সড়ক, নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়ক, কাটিরহাট-সমিতিরহাট-আজাদীবাজার, সমিতিরহাট-নানুপুর সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানিতে ডুবে আছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এসব সড়কের বিভিন্ন স্থানে।
এছাড়া বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে এবং পানির স্রোতে ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। হালদার ওপর নির্মিত নারায়নহাটের কাঠের ব্রিজটি পানির স্রোতে ভেসে গেছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন হাটবাজারে বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য।
এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে নিঁখোজ হওয়ার একদিন পর সামি (১২) নামে এক শিশু এবং রজি আহমদ (৫৫) নামে দৃইজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। নিহত সামি দাঁতমারা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড সাদিনগরের ভাড়াটিয়া হামিদের পুত্র বলে জানা যায়।
অন্যদিকে রজি আহমদ ভুজপুরের ৭ নং ওয়ার্ডের সুলতান আহমদের ছেলে,নিখোঁজ ইমরান (২২) নারায়ণহাট ইউপির তাজুল ইসলামের ছেলে।
জানা যায়,সামিসহ তিন শিশু বন্যার পানিতে নিম্নবর্তী সড়ক দিয়ে পার হওয়ার সময় তলিয়ে যায়। এ সময় দুই শিশুকে স্থানীয়রা উদ্ধার করলেও সামিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে দূরবর্তী স্থানে তার লাশ দেখতে পায় স্থানীয়রা।
অন্যদিকে ছেলেকে উদ্ধার করতে রজি আহমদ নামে এক নিখোঁজ বাবার মৃত দেহ উদ্ধার হয়েছে, তিনি ভূজপুরের কবিরা পাড়া এলাকায় ছেলেকে বাচাঁতে গিয়ে নিখোঁজ হন। ছেলেটি বিদ্যুতের খুঁটি আগলে ধরে প্রাণে বাঁচে। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে। তবে নারায়ণহাট ইউনিয়নের মির্জারহাটের হালদার কূলে বন্যায় আটকে পড়াদের বাঁচাতে গিয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া ইমরান কে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুন্দরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আজম বলেন, আমার ইউনিয়নে বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়। গতকাল থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে নিয়ে আমাদের উদ্ধার অভিযান চলছে।
নারায়ন হাট ইউনিয়নের কাউসার সিকদার জানান, নারায়ণহাটের বন্যা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আশপাশের গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি-ঘরে এখনো পানি।
সুয়াবিল এলাকার মোহাম্মদ সেলিম জানান, সুয়াবিলে বন্যা পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। হালদার পাড় ভেঙ্গে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
রোসাংগিরি এলাকার মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, ‘নির্ঘুম রাত কাঠিয়েছি। এলাকার অনেক ঘরে পানি ঢুকেছে।’
বাগানবাজার ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইমন বলেন, ফেনী নদীর পানি আমাদের অনেক বাড়ি ঘর ডুবানো এবং ভেঙ্গে গিয়েছে,অনেক মানুষ পানি বন্দি।
নাজিরহাট এলাকার মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমাদের এলাকায় হালদা নদীর বাঁধ উপচে পানি আসে। দেখতে দেখতে পানি বেড়ে গিয়ে শত শত ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করে।’
এদিকে পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত একর চাষের জমি, পুকুর, মাছের প্রজেক্ট,পোল্ট্রি ফার্ম।
উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলা চাষাবাদদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি কমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ সম্ভব হবে।’
উপজেলায় দুই পৌরসভাসহ প্রায় ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২০ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ৫০ মেট্রিক টন চাল ও চার লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান উপজেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রকল্প অফিসার আবুল হোসেন।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে বন্যা, জলাবদ্ধতা, পাহাড়ধস পরিস্থিতির জন্য খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। বন্যাকবলিত এলাকাবাসীর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খোলা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক গঠিত হয়েছে ২০টি ইউনিয়ন ও ৫টি সদর মেডিকেল টিম। নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্তৃক টিম গঠন করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ফটিকছড়ি উপজেলার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ফটিকছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। রাতে আসা স্বেচ্ছাসেবকরা বোট দিয়ে বিপুল সংখ্যক দুর্গতদের উদ্ধার করা হয়েছে।’