
যায়যায়কাল ডেস্ক: ফ্রান্সের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের চারটির কাছ থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেল।
স্বীকৃতি না দেওয়া একমাত্র দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্র। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে গাজায় সংঘাত দ্রুত বন্ধ হোক, সেটাও তিনি চান।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি ও গাজা সংঘাত নিয়ে ওই মন্তব্য করেন।
এ সময় তিনি জাতিসংঘের সমালোচনাও করেন। ট্রাম্প প্রশ্ন তোলেন, জাতিসংঘের উদ্দেশ্য কী? তিনি বলেন, সবই যেন শুধু খুব জোরালো ভাষার চিঠি লেখা, তারপর সেই চিঠির কোনো কিছু অনুসরণ করা হয় না। এটা ফাঁকা বুলি। শুধু ফাঁকা বুলি যুদ্ধের সমাধান দেয় না।
ট্রাম্প আরও বলেন, কেউ কেউ নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম প্রস্তাব করেছেন। তবে প্রকৃত পুরস্কার হবে কোটি কোটি জীবন রক্ষা করা।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগের দিন সোমবার নিউইয়র্কে এক বিশেষ সম্মেলনে ফ্রান্সসহ নতুন ছয় দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছিল সৌদি আরব ও ফ্রান্স।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় টানা নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। একে জাতিগত নিধন বলে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলের এই হত্যাযজ্ঞের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার স্বীকৃতি দিয়েছিল যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল।
এরপর সোমবার ফ্রান্স ছাড়াও অ্যান্ডোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এ নিয়ে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৫৭টি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল। সেই হিসাবে বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বের এমন সমর্থনের পরও গতকাল গাজাজুড়ে অন্তত ৩৮ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। উপত্যকাটির উত্তরে গাজা নগরীর আরও ভেতরে প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ
চালিয়েছে তারা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর প্রায় দুই বছরে সেখানে ৬৫ হাজার ৩৮২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ফিলিস্তিনি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যদেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। এই পাঁচ দেশের কোনো একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে তোলা কোনো প্রস্তাবের বিষয়ে ভেটো (নারাজি) দিলে সেটি নাকচ হয়ে যায়। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের আগে ১৯৮৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আরও দুই সদস্য রাশিয়া ও চীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি হয়। এর মাধ্যমে যে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ‘আমরা একত্র হয়েছি, কারণ সময় এসে গেছে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে ক্ষমতার মধ্যে থাকা সবকিছু করা আমাদের দায়িত্ব।’
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
নিউইয়র্ক সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘একটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের অধিকার, কোনো পুরস্কার নয়।’
রোববার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশ যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের নেতারাও নিউইয়র্ক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন গত বছর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া তিন দেশ—স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের নেতারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, জার্মানি ও ইতালির কোনো প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেননি।
সম্মেলনে যোগ না দিলেও গতকাল নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, তিনি ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে নন। গাজা থেকে যদি বাকি সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং উপত্যকাটি শাসন কার্যক্রম থেকে হামাসকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখনই কেবল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে ইতালি। স্বীকৃতির একটি প্রস্তাব ইতালির পার্লামেন্টে তুলবেন বলেও জানান তিনি।
ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও কথা বলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী। তবে গাজায় চলমান নৃশংসতার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা না করে বরং হামাসের ওপর দোষারোপ করেন তিনি।
মেলোনি বলেন, ইসরায়েলের বদলে হামাসের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ দেওয়া উচিত। কারণ, হামাসই এই সংঘাত শুরু করেছে এবং জিম্মিদের আটকে রেখে সংঘাত শেষ হতে দিচ্ছে না।
এর আগে ইউরোপের দুই প্রভাবশালী দেশ জার্মানি ও ইতালি অবশ্য বলেছিল, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের। এরপর সোমবার ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির দাবিতে ইতালিজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কোনো কোনো স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দাঙ্গা পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এরপর স্বীকৃতি নিয়ে কথা বললেন মেলোনি।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ, অবৈধ অভিবাসন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি গাজা ইস্যু নিয়ে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
তিনি বলেন, ‘গাজায় একটি যুদ্ধবিরতির জন্য গভীরভাবে যুক্ত আছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের দ্রুত গাজায় সংঘাত থামাতে হবে।’
আলোচনার মাধ্যমে গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে উল্লেখ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, গাজায় বন্দী থাকা বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে হবে। জীবিত ২০ জনের সবাইকে ফিরিয়ে আনতে হবে। মৃত ৩৮ জনের মরদেহও ফেরাতে হবে।
ফিলিস্তিনকে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, এটি হামাসকে পুরস্কৃত করবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এই হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। প্রায় আড়াই শ জনকে জিম্মি করে নিয়ে আসা হয় গাজায়। সেদিন থেকেই উপত্যকাটিতে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েল সরকারের হিসাবে, গাজায় এখন ৪৭ জন জিম্মি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন জীবিত আছেন বলে ধারণা তাদের।
ভাষণে জাতিসংঘের সমালোচনাও করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন শান্তি প্রচেষ্টায় সমর্থন জানাতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের কাছাকাছিও যাচ্ছে না তারা।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার মুসলিম আটটি দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ট্রাম্পের।
দেশগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। সেখানে গাজা সংঘাত বন্ধে ট্রাম্প একটি প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। সেখানে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করার কথা।
আরব ও ইসরায়েলি সূত্রের বরাতে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২-এর খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আঞ্চলিক দেশের সেনা মোতায়েন, উপত্যকাটিতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনর্গঠনের বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা মুসলিম নেতাদের জানাতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এই বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর যোগ দেওয়ার কথা। সোমবারের সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে প্রস্তুত আছে তাঁর দেশ। এদিন মাখোঁর প্রস্তাবিত একটি কাঠামোতেও সংঘাত শেষে গাজার শাসনভার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার কাজে সহায়তার জন্য একটি ‘আন্তর্জাতিক বাহিনী’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির বিষয়টি ‘সার্কাস’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের দূত ড্যানি ড্যানন।
আর ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছেন, পশ্চিমাদের এই স্বীকৃতির জবাবে পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন তারা। যদিও বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে অবৈধ বসতি স্থাপন করে আসছে ইসরায়েল।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল তিন উপায়ে ফিলিস্তিনকে পশ্চিমাদের স্বীকৃতির জবাব দিতে পারে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট কাউন্সিল অব গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক পরিচালক আদেল আবদেল গাফার।
আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ইসরায়েল প্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে পারে তা হলো, ফিলিস্তিনের আরও ভূখণ্ড ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করা। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যেন বাস্তবতার মুখ না দেখে। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি হলো, যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে আনা। আর শেষ পদক্ষেপটি হলো, স্বীকৃতি দেওয়া কিছু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা। যেমন অস্ট্রেলিয়া। দেশটিতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এমন দেশগুলোয় বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ইসরায়েল, যেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি বাতিল করা যায়।