
যায়যায়কাল প্রতিবেদক: প্রায় একশ বছরের মধ্যে দেশে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। সেদিক থেকে এই ভূমিকম্পটিকে ‘ফোরশক’ বলা যায়।
অর্থাৎ, একটি বড় ভূমিকম্প আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো হয়, এটি তার মধ্যে একটি।
শুক্রবার সকালে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী।
তিনি বলেন, ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১২৫ বছর পরপর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর আসার সম্ভাবনা থাকে। ১৯৩০ সালের পর দেশে বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
তিনি জানান, ১৮৬৯ সালে ৭.৬ মাত্রার কাছাড় ভূমিকম্প, ১৮৮৫ সালে ৭.১ মাত্রার বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালে ৮.১ মাত্রার ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান’ ভূমিকম্প এবং ১৯১৮ সালে ৭.৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগের ইতিহাস রয়েছে এ অঞ্চলের।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারা দেশ। এর কেন্দ্র ছিল ঢাকার কাছে নরসিংদীতে।
ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে তিনজন এবং নরসিংদীতে দুজন ও নারায়ণগঞ্জে দেয়াল ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে শতাধিক আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ বলেন, আজকের ভূমিকম্পটির স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ২০ সেকেন্ড। এতেই ঢাকা শহরের অনেক বাড়ি ও স্থাপনায় ফাটল দেখা দিয়েছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ করায় এমনটা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখের মতো ভবন আছে। রানা প্লাজা ধসের পর আমরা বারবার ভবনগুলো পরীক্ষা করার কথা বলেছি। বিশেষ করে ঢাকার ২১ লাখ ভবন জরুরিভিত্তিতে পরীক্ষা করা দরকার। সরকারের উচিত রাজউকের মাধ্যমে ভবন পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া এবং কোড অনুযায়ী নির্মিত কি না, ভবন মালিককে এর সনদ জমা দিতে বলা।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমাদের হিসাব বলছে, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে এক থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে এবং শহরের প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে।’
তিনি ভবনগুলোকে সবুজ, হলুদ ও লাল—এই তিন শ্রেণিতে চিহ্নিত করার ওপর জোর দেন। সবুজ মানে ঝুঁকিমুক্ত, হলুদ মানে সংস্কার প্রয়োজন এবং লাল ভবন মানে অবিলম্বে খালি করে মজবুত করা জরুরি। এটা আমেরিকা, জাপান, এমনকি ভারতেও করা হয়েছে।
ঢাকার আশপাশে এত বড় ভূমিকম্প আগে হয়নি’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাইয়াত কবির বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ইন্ডিয়ান ও ইউরোশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। আমাদের এখানে আসাম ফল্ট, ডাউকি ফল্ট ও উত্তর-পূর্বে মিয়ানমারের সেগাইং ফল্টের মতো চ্যুতি রয়েছে।
‘এ কারণে আমাদের এখানে বিভিন্ন সময় কম-বেশি ভূমিকম্প হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবেও আমাদের এখানে বড় ভূমিকম্প হওয়ার রেকর্ড আছে। এ ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয়, কিন্তু আজকের ভূমিকম্পের মাত্রা হয়তো একটু বেশি ছিল।’
তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ শুরুর পর থেকে ঢাকার আশপাশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প এটাই সর্বোচ্চ।
রুবাইয়াত কবির বলেন, সাধারণত একটি বড় ভূমিকম্পের পর ‘আফটার শক’ বা পরাঘাতের আশঙ্কা থাকে, যদিও এখন পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি।
তিনি ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানান।












