বাবুল খাঁন, নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ভুমিতে উৎপাদিত জুম চাষের ধান কাটা শুরু হয়েছে জুমিয়াদের মুখে হাসি ফুটেছে। চোখের দৃষ্টি যতদুর যায় বিশাল সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দুর থেকে দেখা যায় সবুজ পাহাড়ের জুমের সোনালী রঙের পাকা ধান।
এবছর বৃষ্টি দেরীতে হওয়ার কারনে জুমের ধান বপনে সময়ের ব্যবধান বেশী হয়েছে তাই এখন কেউ ধান কাটা শুরু করেছেন, কোন কোন জুমের ধান এখনো সবুজ আবার কোথাও ধান পাকা শুরু হয়েছে এমন জুমের ধান পাহারা দিতে জুম চাষী স্বপরিবারে জুম ক্ষেতে উঠেছেন, কেউ ধান কাটার আগে সাথী ফসল বিশেষ করে মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল সংগ্রহ করা শুরু করেছেন, আর কেউ জুমের পাকা ধান কাটার জন্য উপযুক্ত সময় অপেক্ষা করছেন। তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় এখন জুমচাষীদের দম ফেলার ফুসরত নেই, জুম চাষ ঘিরে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটারদুরে থানচি উপজেলা বলিপাড়া ইউনিয়ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কমলা বাগান পাড়ার বাসিন্দা জুমচাষী মিলন ত্রিপুরা (৪০) স্বপরিবারে এবং শ্রমের বিনিময়ে কাজ করান ১৫ জনের একদল নারী-পুরুষের দলবলনিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। ধান কাটতে কাটতে তিনি জানান এ বছর ১২ আড়ি জায়গায় (১ আড়ি সমান ১০ কেজি) ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছেন। এবছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি, কারন যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন অতিবৃষ্টি । আগে সময় মতো রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো, এখন সময় মতো রোদ-বৃষ্টি কিছুই হয় না, প্রকৃতিও উল্টো হয়েছে। এবছর জুম থেকে ২শ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন। যদি জুমের ধান ভালো হতো তাহলে ৩শ আড়ি ধান পেতেন। তারপরও যা পাবেন এবছর জুমের ধানে কোনো মতে বছর যাবে।
তিনি যোগ করেন, অনেক জুমচাষীর জুম এবছর ভালো হয়নি। যা ভালো হয়েছিল ধান কাটার উপযুক্ত সময়ে টানা ৪-৫দিন বৃষ্টি হওয়াতে অনেক জুমচাষীর পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। তাই আগামীবছর খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে জানান তিনি।
পুষ্পরানী ত্রিপুরা (১৮) জানান তারাও জুম চাষ করেছেন। কিন্তু তাদের জুমের ধান এখনো কাটার উপযুক্ত হয়নি। তাই তাদের প্রতিবেশী দুলাভাইয়ের পাকাধান শ্রমের বিনিময়ে কাটতে সহযোগিতা করছেন। কিছুদিন পর তাদের জুমের ধান কাটার উপযুক্ত হলে তাদের থেকেও শ্রম দিয়ে জুমের ধান কাটার সহযোগিতা পাবেন বলে জানান তিনি।
প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়, জানুয়ারি -ফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটা হয়, তারপর কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পরে মার্চ- এপ্রিল মাসে কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়ার জন্য প্রথমে ফায়ারিং লাইন করে জঙ্গল পোড়ানো হয়, এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিস্কার করে ধান বপনের জন্য প্রস্তুত করে কাঙ্খিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে, বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সাথীফসল বপন করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সাথীফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে আর যারা একটু দেরীতে বপন করেন তাদের ধান দেরীতেই পাকে। প্রতিবছর আগষ্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর – অক্টোবর পযর্ন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব ।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বান্দরবান জেলায় জুম আবাদের তথ্যমতে বিগত ২০২১ সালে আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জায়গায়। আর উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৭ দশমিক ২২ টন চাউল। ২০২২ সালে আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২৯২ হেক্টর জায়গায় আর উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৪১৮ দশমিক ১২ টন চাউল। ২০২৩ সালে জুম চাষ আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জায়গায় আর উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৯ দশমিক ৭১ টন চাল। চলতি বছর ২০২৪ সালে জুম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৪৬০ হেক্টর জায়গায়, আবাদ অর্জনে ৮ হাজার ২৬৭ হেক্টর। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ টন চাউল, বর্তমানে জুমের ধান কর্তন চলমান রয়েছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. হাসান আলী জানান, বান্দরবানে চলতি বছর প্রায় ৮ হাজার তিনশ’ হেক্টর জায়গায় জুমের আবাদ হয়েছে। জুমে ধান ছাড়াও সাথীফসল হিসেবে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। এ বছর জুমের ফলন ভালো হবে আশা করা যায় তবে পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে বৃষ্টি সব জায়গায় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। যার কারণে উৎপাদনে তারতম্য হয়, একেক জায়গার ফলন একেক রকম হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলায় জুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে আর অন্যান্য উপজেলায়ও জুমের ধান কাটা শুরু হবে। জুমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষিবিভাগ বিভিন্ন পরামর্শ এবং স্থানীয় জাতের সাথে হাইব্রিড জাতীয় ধান উৎপাদন করার জন্য উৎসাহ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে বলে জানান তিনি।