নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ২ আগস্ট ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি জামে মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয় এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
উল্লেখ্য যে, ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারী টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবার ছাড়াও তার পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাকে খান বাহাদুর উপাধি প্রদান করেছিল। তিনি টাঙ্গাইল-এর বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়-এর শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।১৯৪০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এমএ এবং বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন যুদ্ধকালীন সরকারের বিদেশের বিশেষ প্রতিনিধি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরোচিত ও অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
১০ জানুয়ারি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১-এর ১৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর গুলিবর্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হওয়ার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বিদেশি পত্রিকা ও বেতারে প্রচারিত হলেও আবু সাঈদ বা বাঙালি জাতি তখনও কিছুই জানেন না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ওই কঠিন দুঃখের সময়ে অনেকটা ত্রাণকর্তার মতোই আবির্ভূত হন বিচারপতি চৌধুরী। বিবিসিতে পাকিস্তানি বর্বরতার কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১ দিন পর ২৭ মার্চ শনিবার লন্ডনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে বলেন, ‘আমি পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি জাতির ওপর বর্বর হত্যাকান্ডের কথা বিশ্ববাসীকে জানাবো।’ তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন এবং পাকিস্তানি সামরিক চক্র যাতে নবজাত রাষ্ট্রের পিতাকে হত্যা করতে না পারে, এজন্য তিনি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বিবিসির মাধ্যমে প্রচারিত আবু সাঈদ চৌধুরীর ওই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষকে যেমন সাহস জোগায় তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। যুদ্ধকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগেই তিনি লন্ডন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। পাকিস্তানি সামরিক চক্র লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। এমনকি তাকে হত্যারও চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি।
১৯৭২ বিকেলে জাতির পিতা স্বদেশে আসেন। ১২ জানুয়ারি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। লন্ডন থেকে বিচারপতি চৌধুরী দেশে ফিরে আসেন ৮ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ওই দিন সকালে লন্ডন পৌঁছেন।
১৯৭৮ সালে জাতিসংঘে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের অবসান এবং তাদের নিরাপত্তা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮৫ সালে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন।
১৯৮৫ সালে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ডিগ্রি প্রদান করে।
তিনি টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টর অব ল এবং বিশ্বভারতী ‘কোওম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এবং বিশিষ্ট সমাজসেবক লায়ন আবুল কাশেম চৌধুরী তার দুই ছেলে।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগবাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।