
রংপুর প্রতিনিধি: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে নানা গুঞ্জন। বিশেষ করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রো-ভিসি পদের জন্য একাধিক শিক্ষক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আলোচনা আছে। তবে ওই পদে বসতে সবচেয়ে বেশি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন বাংলা বিভাগের বিতর্কিত শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ।
তিনি বিভিন্ন রূপ ধারন করে সব ভিসির আমলেই সুবিধা গ্রহণ করেছেন। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের তকমা লাগিয়ে নানা সুবিধা গ্রহণ করা এই তুহিন ওয়াদুদ ভিসি হওয়ার জন্যও বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার সাথে সম্পর্কের খাতিরে জোর লবিং শুরু করেছিলেন।
বিশ্বদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ রংপুরের মানুষের সমালোচনার মুখে সফল হতে পারেননি তিনি। গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলীকে বেরোবির ভিসি হিসেবে নিয়োগ প্রদানের পর এখন তিনি প্রো-ভিসি হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, নতুন প্রশাসন এলে শিক্ষকদের মধ্য থেকে যারা প্রো-ভিসি হতে চান তাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের সদস্য। পরে নীল দল থেকে নির্বাচন করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতিও হয়েছিলেন। সরকার পদত্যাগের আগে বেরোবির উপাচার্য হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদে ছিলেন। যোগ্যতা না থাকলেও ২০০৯ সালে প্রভাষক হিসেবে বাংলা বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। অধ্যাপক পদে নিয়োগের সময়েও অনিয়মের অভিযোগ আছে।
সূত্র মতে, ২০১৬ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ,বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেনে। পরে প্রিন্ট করা সেই পত্রিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের উচ্চ মহলে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন। ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর বেরোবির নীল দলের আয়োজনে শেখ রাসেল মিডিয়া চত্ত্বরে বিএনপি ও জামায়াতের অবৈধ হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে শান্তি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই শান্তি সমাবেশ আয়োজনে তুহিন ওয়াদুদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ রংপুর জেলা শাখার প্রকাশনা পরিষদের সদস্য এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুগ্ম আহবায়কের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
তুহিন ওয়াদুদ ছাড়াও যারা প্রো-ভিসি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মতিউর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ বেরোবি শাখার প্রতিষ্ঠাতা এবং নীল দল গঠনের মাস্টার মাইন্ড। সদ্য সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রশিদের আমলে বিভিন্ন পদের সুবিধাভোগী।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুল হক (শিমুল মাহমুদ)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলুদ দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে নীল দলের উপদেষ্টা। তিনি সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য হাসিবুর রশিদের নিয়োগকৃত শিক্ষা গবেষণা সম্প্রসারণ দপ্তরের পরিচালক। এই দুই অধ্যাপকও বহুরূপী তুহিন ওয়াদুদের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। প্রো-ভিসি হওয়ার দৌড়ে আরো যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক সরিফা সালেয়া ডিনা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলুদ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ উপ কমিটির সদস্য।
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি সাবেক উপাচার্য জলিল মিয়ার ভায়রা ভাই এবং অনেক অবৈধ নিয়োগের সহযোগী হিসেবে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি হলুদ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সদ্য সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রশিদের আমলে বিভিন্ন পদের সুবিধাভোগী। প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার ছাড়াও প্রশাসনের বর্তমান কাঠামোতেও অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদের অনেক ঘনিষ্টজন এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সদ্য সাবেক উপাচার্য হাবিবুর রশিদের আমলে অবৈধভাবে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আলমগীর চৌধুরী। হাসিবুর রশীদের প্রশাসনে রেজিস্ট্রারের সহায়তায় তুহিন ওয়াদুদ অনেক অপকর্ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ঘনিষ্ট শিক্ষক ও নীল দলের বর্তমান সভাপতি ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিতাই কুমার ঘোষ এখনো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিতাই ঘোষ তুহিন ওয়াদুদের কথা ছাড়া চলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাইদুল হকও হাসিবুর রশীদের আমলে গবেষণা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
গত ১৮ আগস্ট সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত সম্ভব আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। এটা একটা সুযোগও আমি মনে করব। আমরা চাইব, এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এতদিন এই জায়াটায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন, তাদের কোনো অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার। আন্দোলনে ভূমিকা ছিল এবং একাডেমিকভাবে যোগ্য, এমন ব্যক্তিদের শীর্ষ পদে দেখতে চান শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মাহমুদ কাইসার রাকা বলছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক শুধু তেল দিয়ে চলে ক্ষমতার লোভে, নতুন ভিসি আসলে পল্টি মেরে নতুন রূপ ধারণ করে, সেসব শিক্ষক যাতে কোনোভাবে প্রশাসনের দায়িত্বে না আসে। এছাড়াও দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের ব্যানারে যেসকল শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্বে থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আমরা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই তাদের আর চাই না।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি প্রতিনিধি আরমান বলেন, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট মুক্ত করবেন এমন দায়িত্বশীলকে দেখতে চাই। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দায়িত্ব পালন করার। আমাদের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা ও ব্যাঘাত ঘটেছে, তা দূর করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুতই গতিশীল করবে বলে আশা করি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেমন হওয়া উচিত- জানতে চাইলে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসসি) বিভাগের শিক্ষক ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ত্বশীল ব্যক্তিদের মাঝে অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী চেতনা রক্ত-মাংসে লালন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়েছে দুটি বিষয়ের জন্য। একদিকে জ্ঞানচর্চা, আরেকদিকে জ্ঞান সৃষ্টি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ- এ দুটোকে যারা এগিয়ে নিতে পারবেন, একই সাথে প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, সাহসী, উদ্যোগী, উদ্যমী এ রকম মানুষকেই দায়িত্বে থাকতে হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ সৎ, দক্ষ, মেধাবী এবং বাংলাদেশপ্রেমী অধ্যাপকবৃন্দকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল পদসমূহে বেছে নিবেন বলে নতুন উপাচার্যের কাছে সবাই আশাবাদী।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত, সেহেতু এসব শিক্ষকের মধ্য থেকেই নতুন উপাচার্য যিনি আসবেন, তাদের নিয়েই কাজ করতে হবে। অনেক দলনিরপেক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের সংস্কৃতি চালু আছে তা হলো যে সরকারের আমলে যিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাকে অনেকটা বাধ্য হয়ে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো দলের ফরম পূরণ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন,নতুন উপাচার্য এলে তার উচিত পূর্ববর্তী উপাচার্যদের আমলে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না, তাদের প্রাধান্য দেওয়া। সেই সঙ্গে পূর্বে যারা দায়িত্ব পালনকালে কোনো প্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ফেরদৌস বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো আওয়ামীপন্থী অনেক শিক্ষক প্রশাসনে আসতে অনেক তোড়জোড় করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল কাজ নিজে গবেষণা করা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা। যারা এগুলো করছে, তাদের বিগত কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যাবে তারা আসলে কী চান। আমরা সবাই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আমাদের নতুন উপাচার্য এসেছেন। তিনি একজন ভালো মানুষ। আশা করি ভালো কিছু হবে।