
জাহাঙ্গীর আলম শাহিন: রাজধানীর মিরপুরে অবৈধ লেগুনায় চাঁদাবাজি করে মোহাম্মদ সেলিম মিয়া নামে এক শ্রমিক লীগ নেতা এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। মিরপুর-১ নম্বরে চলাচল করা লেগুনার চালক ও মালিকরা তার বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবজির অভিযোগ এনেছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও মোহাম্মদ সেলিম মিয়া লেগুনা পরিবহন থেকে আগের মতো চাঁদাবাজি শুরু করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহাম্মদ সেলিম মিয়ার জন্ম ফরিদপুর জেলার সালথা থানার উত্তর চন্ডী পদ্ধি গ্রামে। তার বাবা শামস উদ্দিন একজন দুধ বিক্রেতা ছিলেন। কয়েক বছর আগে ফরিদপুর থেকে ভোটার আইডি কার্ড পরিবর্তন করে গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর নিয়ে আসেন তিনি। এরপর গোপালগঞ্জের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হন বলে জানা যায়।
সেলিম মিয়ার বর্তমান ঠিকানা ৩১২/৪/এস/২, লালকুঠি, দারুস সালাম, মিরপুর।
জানা যায়, তিনি এক সময় সেনাবাহিনীর কর্পোরাল পদে চাকরি করতেন। অনিবার্য কারণে ২১ বছরের মাথায় তার চাকরি চলে যায়।
জানা যায়, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মোহাম্মদ সেলিম মিয়া ২০১৬ সালে মিরপুর স্টাফ কোয়ার্টারে ৮ হাজার টাকার বাসা ভাড়া নিয়ে দিনযাপন শুরু করেন।
পেনশনের টাকা দিয়ে ২০১৭ সালে সেলিম মিয়া দুটি লেগুনা কিনে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজিতে। চাঁদাবাজদের সাথে যুক্ত হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে আরো চারটি লেগুনা কেনেন। সব মিলিয়ে মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বর্তমান ১৪টি লেগুনার মালিক। মিরপুরে-১ থেকে চারাবাগ পর্যন্ত তার লেগুনা চলে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরপুর ডাইমেনশনের ব্যানারে প্রতিদিন ১৩০টি লেগুনা চলে। প্রতিটি গাড়ি থেকে দিনে ১২শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয় সেলিমকে। সে হিসেবে মাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যদি কোনো মালিক চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় প্রশাসনের সাহায্যে তার গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেয় এবং গাড়ি রাস্তায় চলতে দেওয়া হয় না। এতে তাকে সাহায্য করেন রূপনগর, শাহআলী ও দারুস সালাম থানার বেশ কিছু সার্জেন্ট ও টিআই। যারা প্রতি মাসে মোহাম্মদ সেলিম মিয়ার কাছ থেকে মোটা অংকের মাসোয়ারা নিয়ে থাকেন।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পরেই তার সহযোগী চাঁদাবাজদেরকে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। বর্তমানে সেলিমের চাঁদাবাজ বাহিনী আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মিরপুরের সকল লেগুনা মালিকগণ ৮ বছর ধরে নির্যাতিত এবং নিপীড়িত মাস্টারমাইন্ড সেলিম মিয়ার কাছে। তিনি মিরপুরে চাঁদাবাজির এক ‘স্বর্গরাজ্য’ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তার চাঁদাবাজির ব্যাপারে মালিক পক্ষের কেউ কথা বললেই হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে তার পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
এদিকে চাঁদাবাজির টাকায় নিজের সামাজিক অবস্থানও পরিবর্তন করে হয়েছিলেন দারুস সালাম থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম মিয়া। সকল ধরনের চাঁদাবাজিতে সেলিমকে সহযোগিতা করেন জাকির সিকদার। যিনি কিছুদিন আগে সেলিমের কথায় এক অসহায় পরিবারের দুই ভাইয়ের নামে মামলা দিয়েছেন দারুস সালাম থানায়। এই জাকির প্রতি মাসে জেলারের নাম বলে প্রত্যেকটা গাড়ি থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন বলে জানা যায় ।
সুমন দেওয়ান, সাগর সেলিমের বেতনভুক্ত ম্যানেজার। যারা সমস্ত চাঁদার টাকা প্রতিদিন দুইবার করে বাসায় জমা দিয়ে আসেন।
সেলিমের নিজস্ব লোক শাহিন, আসাদ, রনি ও মান্নান ২০২২ সালে চাঁদা তুলতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর তাদেরকে দারুস সালাম থানায় সোপর্দ করে। যে মামলা এখনো চলমান রয়েছে। এরা সবাই সেলিমের বেতনভুক্ত কর্মচারী। ল্যাইনম্যান জাকিরের দুটি লেগুনা আছে। আর ল্যাইনম্যান সুমনের তিনটি লেগুনা আছে।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান চাঁদাবাজ সেলিম বর্তমানে শত কোটি টাকার মালিক। বছরখানেক আগে ৭০/৮০ লাখ টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। ঢাকায় রয়েছে তার নিজস্ব ফ্লাট।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সেলিম মিয়া বড়। ছোট ভাইয়ের নামে করেছেন মুকসুদপুর সদর জসিমউদদীন প্লাজার দ্বিতীয় তলায় সোহেল ফ্যাশন নামে কাপড়ের দোকান এবং মুকসুদপুর সদর খান প্লাজার ২য় তলার ডান পাশে ক্লিনিকের ব্যবসা।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে শ্বশুরের কাছ থেকে জোর করে নিয়েছেন ২টি ফ্ল্যাট । সেলিমের নিজস্ব কেনা ফ্লাটটিতে ডেকোরেশন বাবদ খরচ করেছে এক কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ট্যাক্স ফাইলে এই ফ্লাটটির মূল্য দেখিয়েছেন অনেক কম। তার নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা ট্যাক্স ফাইলে তিনি দেখাননি। তাহলে এত সম্পত্তির উৎস কি? এছাড়াও তার ১৪টি লেগুনার কথাও যেগুলো ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ নাই।
এছাড়াও সেনাবাহিনীতে একসময় চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সেনাদের দিয়ে ফোন করে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ লেগুনা গাড়ির মালিকদের।
এমনই ২ জন লেগুনা মালিকের তথ্য পাওয়া গেছে যাদের একজন সাভার বিরুলিয়ার মান্নান ও মিরপুরের রাসেল। মান্নানকে কল দিয়েছিলো ১০ আগস্ট রাত ১১টায় এবং রাসেলকে কল দিয়েছে সাভার ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
সার্জেন্ট মামুন পরিচয়ে এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে তাদেরকে দেখা করতে বলেন এবং মিরপুর মাজার রোডের অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প থেকেও ফোন দেওয়া হয় রাসেলকে। সেনাবাহিনীর পরিচয় দেওয়া ওই ২ জন রাসেল এবং মান্নানকে সেলিমের সাথে সমন্বয় করে ব্যবসা করতে বলেন।
তারা আরো বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের নম্বর কীভাবে পেল? যেখানে বাংলার মানুষ নতুন স্বপ্ন বুনছেন সেখানে আজও সেলিম মিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন মিরপুরের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ রাখতে। তাই আমরা মালিকগণ ডাইমেনশন ব্যানার খুলে ফেলার পরও সেলিম তার সন্ত্রাসী বাহিনীদের দিয়ে ডাইমেনশন ব্যানার জোরপূর্বক প্রত্যেকটি গাড়িতে লাগিয়ে দিয়ে চাঁদা দাবি করছেন।
লেগুনার মালিকগণ আরো বলেন, আমরা একক সিদ্ধান্ত নিয়ে গাড়ির ব্যবসা নিজেরা পরিচালনা করব। কোনো ধরনের ব্যানারে আমরা থাকতে চাই না। চাঁদাবাজদের মিরপুরে কোনো স্থান নেই। এমনকি সেলিম ও তার সন্ত্রাসী বাহিনাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।
কয়েকজন লেগুনা চালকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, আমরা গাড়ি রাস্তায় বের করলেই তাকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে এবং পুলিশ দিয়ে গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেন।
চাঁদাবজির অভিযোগের বিষয়ে জনতে চাইলে মোহাম্মদ সেলিম মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি চাঁদাবজিতে জড়িত নই। লেগুনার মালিকগণ আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।’
পরিবহন বা লেগুনা গাড়িতে চাঁদাবাজির বিষয়ে ছাত্রসমাজ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। এই চাঁদার টাকা জোগাড়ের জন্য চালকরা বেপরোয় গাড়ি চালায়। যে কারণে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। আর গাড়ি চলার ক্ষেত্রে কমিশনিং সিস্টেম বন্ধ করতে হবে বলেও মত দেন তারা।