রাজশাহী প্রতিনিধি: রাজশাহীর আদালতের নতুন সরকারি কৌঁসুলি (জিপি), অতিরিক্ত জিপি, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), অতিরিক্ত পিপি ও সহকারী পিপি নিয়োগ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সলিসিটর সানা মো. মাহরুফ হোসাইন স্বাক্ষরিত পত্রে নিয়োগের বিষয়টি জানানো হয়। তবে চরম বৈষম্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কার্যত বাদ দেওয়া হয়েছে জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহীতে শহীদ দুই শিক্ষার্থীর হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে শুনানি করা আইনজীবীদেরও নিয়োগ হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গত ৩ নভেম্বর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আইন মন্ত্রণালয় পাঠানো ওই পত্রে জেলা জজ, জেলা জজ ও দায়রা, দ্রুত বিচার, বিভাগীয় বিশেষ জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ১ ও ২, সাইবার, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন, সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনাল, মানব পাচার অপরাধ দমন, শিশু আদালত ১ ও ২ এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতে মোট ১২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে এই নিয়োগে। ১২৪ নতুন আইন কর্মকর্তার প্রায় সবাই বিএনপিপন্থী। জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সংগঠন এবং সাধারণ আইনজীবীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। পিপি হিসেবে জামায়াতের কাউকেই নেওয়া হয়নি। মূল পিপির পদ মোট ৩টি। জেলা, মহানগর, জেলা জিপিতে জামায়াতের কেউ নেই। স্পেশাল পিপির পদ ৫টি। সেখানেও জামায়াতের কোনো আইনজীবীকে জায়গা দেওয়া হয়নি।
আরও তিনটি বিশেষ পিপি পদ রয়েছে; যেমন- জননিরাপত্তা, সাইবার ও সন্ত্রাস দমন আদালত। এখানেও পিপি হিসেবে জামায়াতপন্থী কাউকে নেওয়া হয়নি। ৩০ এর অধিক আছে অতিরিক্ত পিপির পদ। জামায়াতকে দিয়েছে মাত্র একটি। অতিরিক্ত জিপির পদও রয়েছে ১২ এর অধিক। এখানেও মাত্র একজন নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতের। দলটির কয়েকজনকে শুধু সহকারী পিপি হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
জামায়াতের আইনজীবীরা বলেন, তালিকা প্রকাশের পর আমরা বিএনপির আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি।
এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে বিএনপির আইনজীবীদের সেক্রেটারি এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নবনিযুক্ত পিপি রাইসুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনজীবীদের সেক্রেটারি ব্যরিস্টার কায়সার কামাল এবং ব্যরিস্টার মিলন (ব্যারিস্টার নাজমুল হকের ভাগ্নে) এ দুইজন মিলে জামায়াতের তালিকা ব্ল্যাকআউট করে বাদ দিয়েছেন।’
জামায়াতপন্থী আইনজীবী ও বার অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হাসানুল বান্না সোহাগ বলেন, এই পদগুলোর সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো বা কমানো যায়। এ তালিকা দেখে আমরা চরমভাবে অসন্তুষ্ট ও মর্মাহত।
আইনজীবীরা অভিযোগ তুলেছেন, গত ৫ আগস্ট রাজশাহীতে শহীদ আলী রায়হান ও শহীদ আনজুম সাকিব হত্যা মামলার আসামিপক্ষের হয়ে মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরাও নিয়োগ পেয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগের আসামিদের পক্ষে ছিলেন, শুনানি করেছেন। তবু তারা সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ পাওয়ার ঘটনায় আইনজীবীদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বিএনপির আইনজীবীদের সেক্রেটারি এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নবনিযুক্ত পিপি রাইসুল ইসলাম নিজেই ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের আসামিদের পক্ষে মামলা লড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শহীদ আলী রায়হান ও শহীদ সাকিব আনজুম হত্যা মামলার আসামিদের জামিনের জন্য তার স্বাক্ষরিত একটি ওকালতনামার কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ওশালতনামায় রাইসুল সিল দেওয়ার পর নামটা ক্রস চিহ্ন দিয়ে কেটে দিয়েছেন। তিনি নিজেই হেয়ারিং করেছেন। এডভোকেট শহিদ উদ্দিন চান্দা তার জুনিয়র। চান্দাও সাথে ছিলেন।
ওই আদালতের অতিরিক্ত পিপি আজিমুস সান উজ্জ্বলও জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের বিপক্ষে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগের আসামিদের হয়ে আদালতে মামলা লড়েছেন। তারও স্বাক্ষর করা ওকালতনামার কপি পাওয়া গেছে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর নতুন পিপি ইমতিয়ার মাসরুর আল আমীনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হয়ে মামলা পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ। বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিএনপিপন্থী আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদীর নামও রয়েছে এই তালিকায়।
এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট রাইসুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সব হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওদের ১০ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এরপর জামায়াতের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।
এ বিষয়ে মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির ও রাজশাহী বারের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ সেলিম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে আমরা বৈষম্যের শিকার। আন্দোলন সংগ্রামে যারা মিছিল মিটিং করেছে, তাদের নাম নাই। এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানাই আমরা। বৈষম্যহীন ও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বৈষম্য হওয়ার কথা স্বীকার করেছে খোদ মহানগর বিএনপিও। এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা বলেন, এটা জুনিয়ররা সিনিয়ররা মিলে করেছে। আমার সাথে তারা কোনোরকম আলোচনা না করেই এটা করেছে। আর কমিটি কীভাবে করছে, নিয়োগ কীভাবে হয়েছে, কতজন হয়েছে- এগুলো কিছুই আমার নলেজে নাই।
জামায়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু জামায়াতকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেহেতু এটা তো অবশ্যই বৈষম্যের মধ্যে পড়ে।
এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও রাসিকের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বলেন, রাজশাহী বারের রাজনীতি বিএনপি ও জামায়াতের যৌথ আলোচনার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আমরা সিনিয়র আইনজীবী মিজানুর রহমান সাহেবের সাথে আলোচনা করে একটা খসড়া পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আমি এই নিয়োগে সন্তুষ্ট না।