বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

, এর সর্বশেষ সংবাদ

র‌্যাবের গোপন বন্দিশালা নিয়ে ভয়ংকর তথ্য

যায়যায়কাল প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকে মানুষকে তুলে নিয়ে গুমের ঘটনায় ১ হাজার ৬০০টি অভিযোগ জমা পড়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনে। এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখছে কমিশন।

এ কাজ করতে গিয়ে জোরপূর্বক মানুষকে তুলে নিয়ে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হতো, এমন আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পেয়েছে তারা।

কমিশনের ভাষ্যমতে, র‌্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এসব গুমের ঘটনায় জড়িত।

মঙ্গলবার দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরার জন্য গুলশানে তাদের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কার অভিযোগগুলো তাদের কাছে এসেছে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০–এর বেশি অভিযোগ পেয়েছেন তারা। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এ অভিযোগগুলো দেওয়া হয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত ১৪০ জন অভিযোগকারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যে ৪০০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানে ১৭২টি ঘটনায় র‌্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ৩৭টিতে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সম্পৃক্ততা ছিল ৫৫টিতে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৬টিতে এবং পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৫টিতে। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট কোনো বাহিনীর পরিচয় না দিয়ে প্রশাসনের লোক বা সাদাপোশাক পরিহিত অবস্থায় থেকে কাউকে তুলে নিয়েছে, এমন ৬৮টি ঘটনা পাওয়া গেছে।

অভিযোগ দেওয়ার সময় ৩১ অক্টোবর শেষ হয়েছে। তবে এখনো যদি কেউ যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে অভিযোগ জমা দিতে চান, সেগুলো দেখা হবে বলে জানান কমিশনের সভাপতি।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালার চিত্র বর্ণনা করেন কমিশনের সদস্য নূর খান। তিনি বলেন, ‘একটা মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে, এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর বাইরেও কারও কারও নাম আমরা পেয়ে গেছি। আমরা শুনেছি, আয়নাঘর, যেটা দ্বারা আমরা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারকে বুঝতাম, এর চেয়েও নিকৃষ্টতম সেল আমাদের কাছাকাছি জায়গাতেই ছিল। আমরা সেগুলো পরিদর্শন করেছি।’

ওই গোপন বন্দিশালাটি র‌্যাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো বলে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, ‘বন্দিশালাটিতে আমরা দেখেছি, কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে রাখা হয়েছে। এমনও ঘটনা আছে, সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট—এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দীর প্রসাব-পায়খানার জায়গা। এর মধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হয়েছে।’

ঘরগুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে নূর খান বলেন, ওই ঘরগুলো ছিল বদ্ধ। যেখানে কোনো আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ ছিল না। শুধু ছোট একটা হোল (ছিদ্র) ছিল, যেটা সব সময় লাগিয়ে রাখা হতো। কখনো কখনো বন্দীকে দেখার জন্য সেটা খোলা হতো। ড্রেনেজ সিস্টেম ছিল, ওখানেই বন্দীকে প্রসাব-পায়খানা, গোসল করতে হতো। জায়গাটা সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট। বছরের পর বছর, মাসের পর মাস এভাবে রাখা হতো।

প্রশ্নোত্তর পর্বে কমিশনের সভাপতি বলেন, ‘আমরা বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করছি। ডিজিএফআই, উত্তরা র‌্যাব-১, র‌্যাব সদর দপ্তর, নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব-১১, মোহাম্মদপুরের র‌্যাব-২, আগারগাঁওয়ে র‌্যাব-২–এ ক্রাইম প্রিভেনশন সেন্টার পরিদর্শন করেছি। ডিবি কার্যালয়ও এর আগে পরিদর্শন করা হয়েছে।’

গুমের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’

গুম হয়েছেন, এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, তাদের বিষয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘অনেক ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। অনেকের খবর পরিবারও জানে না, আমরাও পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫৩ বছর আগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আপনারা জানেন, বিচারকেরা রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার ট্রাস্টিজ। অনুরূপভাবে মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সার্বভৌম নির্বাহী ক্ষমতার ট্রাস্টিজ। সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার ট্রাস্টিজ। যদি এই তিন শ্রেণির মানুষ ট্রাস্টিজ হিসেবে সুচারুরূপে কাজ করত, তাহলে দেশের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা হয়নি। এটা আমাদের কালেক্টিভ ফেইলিউর।’

রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে এ দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না উল্লেখ করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘এখন স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন ওঠে, রাজনীতি কে পরিশুদ্ধ করবে? রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। কেবল সৎ, নির্লোভ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমী এবং দক্ষ রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে পারেন।’

কমিশনের সভাপতি বলেন, ‘আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে জাতীয় স্বার্থ কিংবা জনস্বার্থের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে আয়নাঘরের সৃষ্টি। আয়নাঘর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। তবে র‌্যাব-১–এ এটাকে বলে টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল, ডিজিএফআইয়ে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল। বিভিন্ন বাহিনীর অধীন বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু সিক্রেট ডিটেনশন সেন্টার আছে।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ