
যায়যায় কাল প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে সরকার পতনের আগে-পরে দাবি উঠেছে গণহত্যার বিচারের। দেশ ছাড়ার ৯ দিনের মধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তদন্তের আবেদন হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। যেটি তিনি নিজেই গড়ে ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে যেসব প্রাণহানি হয়েছে সেজন্য দায়ি করা হচ্ছে চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে।
বুধবার একই দিনে সহিংসতার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় আনতে একটি হত্যাসহ দুই মামলার পর গণহত্যার অভিযোগ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন জমা পড়ে।
এক আইনজীবীর করা এ আবেদনে তদন্তের কার্যক্রম এগোলে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নিজের গড়া ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের এ সংক্রান্ত এক বক্তব্য আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার খবর এল।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এমন আবেদনের পর যুদ্ধাপরাধের বাইরে সাম্প্রতিক ঘটনায় ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যায় কি না সেই আলোচনাও সামনে আসে। এ নিয়ে মিলেছে দুই আইনজীবীর বিপরীতমুখী বক্তব্য।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন অগাস্টের শুরুতে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিনশ মানুষের প্রাণ যায়।
ছাত্র-জনতার ঢাকামুখী লংমার্চের দিন গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর আসে। সেদিন বিকালে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাংবাদিকদের বলেন, পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথমে হেলিকপ্টার ও পরে সামরিক বিমানে চড়ে আগরতলা হয়ে সেদিন রাতেই দিল্লি পৌঁছান বাংলাদেশের টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী। এখনও তিনি সেখানেই আছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সহিংসতার ঘটনাগুলোকে বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা।
এরই মধ্যে গত দুদিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি পৃথক অভিযোগ হত্যার ঘটনায় এবং অন্যটির অভিযোগ অপহরণ ও নির্যাতনের।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) অ্যাক্ট আছে, যেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধন হয়েছে, সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, জুলাই গণহত্যা বলতে আমরা অগাস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এটার জন্য দায়ী যে ব্যক্তিবর্গ আছেন, উনাদের বিচারের জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উনাদের বিচারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটা ছোটখাটো গবেষণার মত করেছি।
করে দেখেছি, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।
আইসিটিতে ছাত্র হত্যার মামলা চালানোর জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকেও পুনর্গঠন করার কথাও এদিন বলেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিন মামলার পর ট্রাইব্যুনালে আবেদন: কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বুধবার সকালেই সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘গণহত্যার’ ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উদ্যোগ নেবে।
তার এই বক্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যে কোটা সংস্কার ঘিরে সংঘটিত ‘হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের’ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন এক আইনজীবী।
বুধবার করা এ আবেদনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের সময় নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বুধবার এ আবেদন জমা দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান এমন আবেদন জমা হওয়ার তথ্য দিয়ে এটি তদন্তের প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, আমরা অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। এরপর পেপার ওয়ার্ক হবে, আমরা ঘটনাস্থলে যাব, সারাদেশে যেখানে যেখানে ঘটনা হয়েছে সব জায়গায় গিয়ে তদন্ত করা হবে। তারপর প্রতিবেদন জমা দেব।
যাদের ‘ইনস্টিগেটিং’ বক্তব্যের কারণে পুলিশের কিছু সদস্য, র্যাবের কিছু সদস্য রাস্তায় নির্মমভাবে আমাদের ছোট ছোট শিশুকে গুলি করে হত্যা করেছে। এটা গণহত্যা হয়েছে। এই সিস্টেম ক্রাইম, এই পরিকল্পিত ক্রাইম-এটা একমাত্র এই ট্রাইব্যুনালেই হওয়া সম্ভব।
অভিযোগের সময় ও ঘটনাস্থলের বিষয়ে আবেদনকারী আইনজীবী তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ অগাস্ট ২০২৪ পর্যন্ত দেশে ছাত্র-জনতার উপর যে গণহত্যা চলেছে সেই গণহত্যাকে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে তদন্ত করার জন্য আমি একটি দরখাস্ত এনেছি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য যাদের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয় তারা হলেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
এছাড়া রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ।
একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে বলে অ্যাডভোকেট তামিম জানান।
তিনি বলেন, ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযোগটি তদন্ত করবে এবং সত্যতা পেলে মামলা করার সুপারিশ করবে। এরপর এই অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করা হবে।
তামিম আরও বলেন, এসব আসামির পাশাপাশি নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।