
মোঃ নুরুল হক, স্টাফ রিপোর্টার: গোধূলি লগ্নে লাল শাড়িতে, মেহেদি রাঙা হাতে নববধূ সেজে যে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন কিশোরী শেফালী আক্তার, সেই বাড়িতেই একদিন ফিরলেন রক্তমাখা কফিনে মোড়ানো নিথর দেহ হয়ে।
যাওয়ার আর ফেরার এই সময়ের ব্যবধানে শেফালী হয়েছিলেন দুই কন্যার জননী। পরিশ্রম আর মায়ায় গুছিয়ে নিয়েছিলেন ছোট্ট একটি সংসার। ছিলেন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু শশুরবাড়ির লোকজনের দীর্ঘদিনের নির্যাতন আর অবশেষে সম্মিলিত হামলায় তিনি হারালেন জীবনযুদ্ধের লড়াই।
১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ অক্টোবর রাতে মারা যান ৩২ বছর বয়সী গৃহবধূ শেফালী আক্তার।
তার মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া, বইছে ক্ষোভ ও উত্তেজনা। এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবার দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
শেফালীর মরদেহ যখন তার বাবার বাড়ি—নেত্রকোনা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বাঁশআটী গ্রামে—আনা হয়, তখন সন্তান, স্বজন আর প্রতিবেশীদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে রাতের আকাশ।
পরিবার ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৪ বছর আগে কৃষক আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে শেফালীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী গৌরীপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত তোতা মিয়ার ছেলে কাজল মিয়ার বিয়ে হয়।
বিয়ের পর থেকেই শশুরবাড়ির সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। স্বামীর পরকীয়াসহ নানা বিষয়ে বিরোধের জেরে একাধিকবার নির্যাতনের শিকার হন শেফালী। শেষ পর্যন্ত ২৩ সেপ্টেম্বর গৌরীপুর থানায় ভাসুর শাহজাহান, স্বামীর বড় বোন আম্বিয়া ও কবিতা আক্তার এবং স্বামীর ভাগিনা রবিকুলের নামে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
অভিযোগ দায়েরের পর থেকেই তারা শেফালীকে হত্যার হুমকি দিতে থাকে। অভিযোগের মাত্র পাঁচ দিন পর, ২৮ সেপ্টেম্বর, তারা সম্মিলিতভাবে শেফালীর ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ পরিবারের। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে অবস্থার অবনতি হলে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নিহতের বাবা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বারবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি, কিন্তু কেউ রক্ষা করতে পারেনি আমার মেয়েকে।”
এ বিষয়ে গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দিদারুল ইসলাম বলেন, “রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কাজল মিয়ার স্ত্রী শেফালী আক্তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার আহত হওয়ার ঘটনায় একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এখন ভিকটিম মারা যাওয়ায় আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে তাদের বাড়িতে গেলে তারা আত্মগোপনে থাকায় যোগাযোগ সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে শেফালীর হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হোক— যাতে আর কোনো নারী নির্যাতনের শিকার না হয়।