বুধবার, ২২শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

‘সবাই বলতো মারা যাবো, তাহাজ্জুদ পড়ে ক্যান্সার থেকে হলাম সম্পূর্ণ সুস্থ’

শাহ্ সোহানুর রহমান ও আমানুল্লাহ আমানঃ  ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করতে গিয়ে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন মো. লালন সরকার (৩২) নামে এক যুবক।
চিকিৎসার খরচ জোগাতে ঋণের পাশাপাশি জমি বিক্রি করতে হয় তাকে। ছিলেন প্রাণশঙ্কায়। তবে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছেন। তার এই বেঁচে থাকার গল্পের খোজে যায় দৈনিক যায়যায়কাল রাজশাহী ব্যুরো। দৈনিক  যায়যায়কালের কাছে সেই ক্যান্সার থেকে সুস্থ হয়ে নতুন জীবনে ফেরার গোপন রহস্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন লালন।
লালন সরকারের বাসা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নাওদাড়া এলাকায়। তার পিতার নাম শমসের আলী। চারঘাটে থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কৃষিকাজ ও গবাদিপশু পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন লালন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তার ব্লাড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া) রোগ শনাক্ত হয়।
জানা যায়, ২০১৪ সালে চারঘাটের সারদা কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন লালন সরকার। এরপর ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর গাজিপুরে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কর্মজীবন শুরু তিনি। কিন্তু ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হলে হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে বেশকিছু শারীরিক পরীক্ষা করতে বলেন। তখনই রক্তের পরীক্ষা করে জানতে পারেন ব্লাড ক্যান্সারের কথা। তিনি সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহ বাঁচতে পারেন বলে ঢাকার এক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান। বিষয়টি লালনের এলাকাতেও জানাজানি হয়ে যায়।
চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করেন লালন। বারবার পরীক্ষা করে ব্লাড ক্যান্সার রোগ নিশ্চিত হন। এরমধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে তার। গাজিপুরের সেই বেসরকারি কোম্পানি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে তিনি চলে আসেন নিজ গ্রামে। এরইমধ্যে ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য মনস্থির করেন। খরচ জোগাতে আমবাগান ও জমিজমা বন্ধক রাখেন, বিক্রিও করেন ৩ কাঠা জমি। ঋণ করে সার্বিক প্রস্তুতি নেন ভারতে চিকিৎসার। আবেদনের সপ্তাহ তিনেকের ভেতর ভিসা-পাসপোর্ট হাতে পেয়ে ভারতের মোম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন লালন। সেখানে গিয়েও পরীক্ষা করে লিউকেমিয়া রোগ শনাক্ত হয়। শুরু হয় চিকিৎসা। অবস্থার উন্নতি হয়। বেঁচে ফেরার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি।
লালন সরকার দৈনিক যায়যায়কাল কে  বলেন, ক্যান্সার হওয়ার পর কোম্পানি থেকে ছুটি দিত না চিকিৎসার জন্য। পরে গাজিপুরের চাকরিটা থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দেয়। গ্রামে এসে চিকিৎসার জন্য জমি সব ছেড়ে দিতে হয়। ঢাকায় ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার বললেন, ‘মেজর প্রবলেম, ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এরকম রোগী বেশিদিন টিকে না। তবে পয়সা খরচ করলে কিছুদিন বাঁচা যাবে।’ এসব বলে ৩ সপ্তাহ পর আবার চেম্বারে আসতে বললেন। কিন্তু আমি আর যাইনি। বাসায় এসে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
ক্যান্সার আক্রান্তের খবর এলাকায় জানাজানি হলে সমাজ থেকে নানা কটুকথা শুনতে হয়েছিল লালন সরকারকে। অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি বলেন, সামাজিকভাবে আমাকে হেয় করত, কেউ ভাল চোখে দেখত না। অনেকে বলত, আমার বিয়ে হবে না। সবার ধারণা ছিল, আমি মারা যাব। গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল, ক্যান্সার হলেই মারা যায়। ‘লালন বেশিদিন বাঁচবে না’- নানা জন এরকম নানান কথাবার্তা বলতো। অসুস্থতা কী জিনিস, যে আক্রান্ত হয় সে জানে। অনেকে দেখতে আসত। চিকিৎসার টাকা ছিল না; ধার চাইতাম, কেউ দিত না। আমার আপন মামা হেল্প করেনি, কিন্তু চাচাতো মামা করেছে। বাবা-মা খুব কান্নাকাটি করতো। আমি কান্না করতে পারি না, কিন্তু বুকটা ফাইটি (ফেটে) যায়।
চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লালন সরকার বলেন, ডাক্তারের কাছে যেতে সবচেয়ে খারাপ লাগতো। মন চাই না যে, যাই। তবু যেতে হত। ২০ দিনের মধ্যে ভিসা-পাসপোর্ট করে ভারতের মোম্বাই যাই। ওখানে টেস্ট দিল, বাংলাদেশের রিপোর্ট এবং ওখানকার রিপোর্ট সেইম মিলে গেল। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমাকে মোট ২২ বার ভারত যেতে হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের জুন মাসে গেছিলাম। চিকিৎসার জন্য ভারতে আমার মোট ১৫ লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। দেশে খরচ হয় আরও লক্ষাধিক টাকা। চাকরির বেতনের জমানো টাকা, ঋণ নিয়ে, জমি টেন্ডার রেখে এবং জমি বিক্রি করা টাকা দিয়ে ৭ বছর ধরে চিকিৎসা করাই। আমার এই ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেই বেশি, আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে।
সুস্থ হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে লালন সরকার বলেন, ‘ক্যান্সার হওয়ার পর কারো কথা শুনতাম না। নিজের মত চলতাম আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। ইউটিউব দেখে দেখে খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। তিনি জানান, সুগার (চিনি) নিজেই নিষিদ্ধ করেছি, শাকসবজি বেশি খেতাম, ভাজাপোড়া তেলের খাবার বাদ দিয়েছি। লাল মাংস সেরকম খেতাম না। পাশাপাশি আমি ইবাদত শুরু করি। নামাজকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। অসুখ হওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামায়াতে আদায় করতাম। প্রতি সপ্তাহে ২/৩দিন ভোররাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া শুরু করি, আমি নিজে নিজেই উঠতাম। উঠে প্রার্থনা করতাম, আল্লাহ তায়ালাকে সব বলতাম। এরপর ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করতাম প্রতিদিনই। অসুখ হওয়ার পর থেকে আমি মসজিদে গিয়ে বসে থাকতাম। মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত মসজিদে বসেই থাকতাম, মাঝেমধ্যে ওই সময় কুরআন তিলাওয়াতও করতাম। দান-সাদকাও করেছিলাম কিছু।’
লালন সরকার বলেন, আমি এখন পরিপূর্ণ সুস্থ। সব শুকরিয়া আল্লাহ তায়ালার; আমার ফ্যামিলির ওপর আল্লাহ রহম করেছেন, তিঁনি ধৈর্য ধরার তাওফিক দিয়েছেন। নামাজ আর কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সুস্থ হয়েছি, আমি এটাই মনে করি। নামাজে যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। বিয়েও হয়েছে, আমার স্ত্রীও চাকরি করছে। শুধু একটা কথা, আল্লাহ  মানুষকে অসুখ যেন না দেন। অসুখ যে কী কষ্টের, না হলে বোঝা যায় না। আল্লাহ যেন কাউকে ক্যান্সার না দেন।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কথা তুলে ধরে লালন সরকার বলেন, ভোর ৫টায় উঠে ফজর নামাজ পড়ে দিন শুরু করি। এরপর কুরআন তিলাওয়াত করে সকাল সকাল মাঠে ফসলের জমিতে কিছু কাজ করে সকাল ৯টায় অফিস যাই। বিকাল ৫টায় অফিস থেকে এসে একটি দোকানে বিকাল ও সন্ধ্যায় পার্ট টাইম জব করছি। এশার পর বাসায় ফিরে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাই। সবশেষ তিনি বলেন, অনেক টাকা ঋণের মধ্যে আছি। এখন এসব ঋণ পরিশোধ করে নিজে একটা বিজনেস করতে চাই। আর একটা সন্তান আশা করছি। তাহলেই আমি খুশি।
চারঘাটের থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির জেনারেল ম্যানেজার মাইনুল হক সান্টু দৈনিক যায়যায়কাল কে বলেন, ক্যান্সার থেকে লালনের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফিরে আসা ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। বর্তমানে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন তিনি। সুস্থ হওয়ার পর তিনি বিয়ের অনুমতি পান। লালনের বিয়ের পর আমাদের এখানে তার স্ত্রীরও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ