রবিবার, ১৫ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে জাতব্যবস্থা বিলোপ আন্দোলন

উত্তম দাস : মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করতে করতে মানুষ নিজেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের বিভক্ত করে ফেলে এবং একসময় সে একটা শ্রেণীর সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলে। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে ক্ষুদ্র একটি দেশ। বর্তমান জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে একটা জনবহুল দেশ হিসেবে পরিচিত। একটা দেশ পরিচালিত হয় তার সংবিধানের মাধ্যমে যেখানে জনগণের এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে অধিকাংশ নাগরিকই এই পবিত্র সংবিধানে সম্পর্কে ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। যদি জনগণের অধিকার এবং সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে যাই তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।’ ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) শুধুমাত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না। এবং (২) রাষ্ট্র ও জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। এছাড়া দেওয়ানি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি-তে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রদান করে যে কোনো ধরনের বৈষম্য বা সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সংবিধান থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে।

সাধারণ মানুষের চিন্তার মধ্যে ধর্মবোধ কাজ করে এটা যেমন সত্য তেমনি ধর্মবোধের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ এটাও বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র তাকে যে অধিকার সংরক্ষণের অধিকার দিয়েছে সেটা যেন সে ভোগ করে কিন্তু সাধারণ মানুষের চিন্তার সাথে তার এই ভোগের পার্থক্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে বৈষম্য সমাজে এমনভাবে ভর করেছে যেন বৈষম্য ছাড়া একটা সমাজ চলতেই পারছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ঘুষ সমাজে এমনভাবে চেপে বসেছে যে প্রত্যেকটা কাজেই ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় না। তাহলে আমরা কি এটা বলতে পারিনা যে ঘুষ সমাজকে প্রভাবিত করছে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে এটাই স্বীকার করতে হবে যে ঘুষ সমাজকে প্রভাবিত করছে সমাজ ঘুষ কে প্রভাবিত করছে না। কেন ভাই বলা যায় সমাজে যেখানে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় সেখানে মানুষের চাহিদা এবং তার ভোগের একটা প্রকট ফারাক থেকে যায় যেখান থেকে মানুষের মনে অশান্তি সৃষ্টি হয় এবং মানুষ দিন দিন ন্যায্যতা হারিয়ে ফেলে।

আমাদের সমাজে কৃষক শ্রেণীর উপরে একটা অঘোষিত সামাজিক বৈষম্য চলে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চবিত্ত সবাই এটা জানে কিন্তু অবহেলা চলতে থাকে এই শ্রেণীর উপরে হারহামেশা। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুবিধা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে অনেক বেশি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বহু শ্রেণী বা জাতপাত দেখা যায়। তন্মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণ সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। গূগলে সার্চ করে দেখা যায় তফসিলি জাতি (এসসি) ও তফসিলি জনজাতি (এসটি) হচ্ছে সরকারিভাবে স্বীকৃত ভারতের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত আর্থসামাজিক জনগোষ্ঠী।

এই শব্দদুটি ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত। ব্রিটিশ ভারতের বেশিরভাগ সময়কালে তারা অনুন্নত শ্রেণি হিসাবে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশে সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। কোথাও তাদের নাম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলা হয় কোথাও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বলা হয় কোথাও আদিবাসী বলা হয় কোথাও ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী বলা হয় কোথাও আবার নিম্ন আয়ের মানুষ বলা হয় কোথাও আবার ভূমিহীন শ্রেণী মানুষ বা অন্তজ শ্রেণীর মানুষ আবার কোথাও দলিত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলা হয়। কিছুদিন আগে লক্ষ্য করলাম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পিছিয়ে পড়া ৯ পেশার ৫৩ লাখ প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা নিরূপণ করেছে। সরকারি মতে যদি এত সংখ্যা পিছিয়ে পড়ে জনগোষ্ঠী হয় তাহলে বেসরকারি পর্যায়ে নিশ্চয়ই তার অধিক ছাড়া কম নয়। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৪৩টি। সেখানেও কয়েক লক্ষ পিছিয়ে পড়া মানুষের বসবাস। বেসরকারিভাবে জানা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৩৮.৭১ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব কোনো জমি নেই। ৩৫.৮৯ শতাংশ প্রান্তিক মানুষকে বছরজুড়ে খাদ্য সংকটে পড়তে হয়। যেখানেই এত বড় জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারা মানুষের সাথে বৈষম্য দেখা যায় সেখানে কিভাবে একটা সমাজ শৃঙ্খলা বোধ জাগাতে পারে আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

এছাড়া সমাজে আরেকটি বিষয় যথেষ্ট প্রকট। আমরা পিছিয়ে পরে জনগোষ্ঠীকে অনেক সময় কর্মের কারণে তাদেরকে অবহেলা শিকার হতে হয় যেখানে কর্মটাকে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়। কোন কোন সময় জন্মের কারণেও এই জনগোষ্ঠীকে অবহেলার চোখে দেখা হয় যেটা সমাজে কখনোই কাম্য ছিল না অথচ এই জন্ম এবং পেশার কারণে যে বৈষম্য সমাজের সৃষ্টি তার সিংহভাগ দায়ী হলো সমাজের কর্ণধার মানুষগুলো। এখনই সময় সমাজের বিত্তবান মানুষদেরকে এগিয়ে আসা উচিত তা না হলে সমাজের বৈষম্য আরো প্রকট আকার ধারণ করবে যার ফলাফল পরবর্তী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। আমরা অনেকবার শুনেছি ‘জন্ম হোক যথার্থতা কর্ম হোক ভালো’ । সবশেষে বলতে চাই সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য ঘুষে যাক , সকলেই সমান অধিকার ভোগ করুক এবং আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হোক।

লেখক: সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সাংবাদিক

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ