সোমবার, ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

সুরের জগতে এক চিরঞ্জীব সাধক সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

আমির হোসেন: প্রকৃত শিল্পীরা মনুষ্যত্বের সুধা পান করে জীবনে অমরত্ব অর্জন করেন। সুরের দ্বারা ও গানের দ্বারা তাঁরা সৃষ্টি করেন ইহ এবং পর জনমের মধ্যে বিনে সূতির মালায় গাথা সেতু বন্ধন। এই সেতু বেয়ে তাঁরা বিচরণ করেন মানুষের আত্মা থেকে আত্মায়, হৃদয় থেকে হৃদয়ে। একদিন হয়তো এ নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করে তাঁরা আরেক আনন্দলোকে গমণ করেন। এ লোকান্তর মহাকালের সিন্ধুর তরঙ্গে তরঙ্গায়িত। তাঁদের সুরের বিচরণ যেখানে আত্মা থেকে আতœায় মৃত্যু তাদের শেষ কথা নয়। শিল্পীর আত্মা অমর, অক্ষয়, অনশ্বর। কোনো ভঁঙ্গুরতা শিল্পীর আতœাকে কালগ্রস্থ করতে পারেনা। হাজার বছরের আলো যুগ যুগ ধরে তাঁদের আত্মাকে গতিশীল ও জ্যোর্তিময় করে রাখে। তাঁদের সুর তাঁদের করে রাখে চিরঞ্জিব। সুর আর সঙ্গীতের বিশাল আকাশ জুড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে সমস্ত নক্ষত্র উজ্জল আলো বিচ্ছুরণ করে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুরের জগতে এক চিরঞ্জীব সাধক পুরুষ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।

সুরের জগতে চিরঞ্জীব এই সাধক পুরুষের গর্বিত জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার অন্তর্গত প্রকৃতির লীলাভূমি তিতাস বিধৌত এক অজপাড়া গ্রাম শিবপুরে। ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায় সুদূর অতীতে আরব ভূমি হতে যে ক’জন পীর-দরবেশ-আউলিয়া এই দেশে ইসলামের বাণী প্রচার করতে আসে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন তাদের অন্যতম। আলাউদ্দিন খাঁর পিতার নাম সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সাধু খাঁ। সাধু খাঁও ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী মানুষ। তাঁর কাছেই শৈশবে ওস্তাদজী সেতার বাজানো শিখেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি যাত্রার সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। জারি, সারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি সঙ্গীতে ও বাঙলার কীর্তন, পীরের পাঁচালি জাতীয় ধর্ম সঙ্গীত ইত্যাদির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে পিতার হাত ধরেই। সাধু খাঁ ছিলেন অত্যন্ত সরল ও অনাড়ম্বর প্রকৃতির লোক। উদারতায় ভরা ছিল তাঁর অন্তর। তাঁর ছিল পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা। ওস্তাদজী ছাড়াও তাঁর আরও দুই ভাই ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ ও ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ছিলেন উপমাহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ। একদিকে পিতা সাধু খাঁর সেতারে বিশেষ পারদর্শিতা অপরদিকে তবলায় পুত্র আফতাবউদ্দিন খাঁর নৈপুন্য এ দুয়ের সমন্বয়ে সুরের যে তরঙ্গ সৃষ্টি হতো তাতে পিতা-পুত্রে তন্ময় হয়ে দুলতে থাকতেন। অন্যদিকে সুরলোকের বর পুত্র শিশু আলম (আলাউদ্দিন খাঁর ডাক নাম) সুরের তালে দুলতে থাকতো। সাত আট বছর বয়সে আলাউদ্দিনকে ভর্তি করা হয় নিজ গ্রামের জমিদার বাড়ির পাঠশালায়। কিন্তু পাঠশালার লেখাপড়ায় তাঁর মন মোটেও বসতনা। পারিবারিক পরিবেশের কারণেই সঙ্গীত জগৎ কেড়ে নিয়েছিল শিশু আলমের মন প্রাণ। পিতা মাতার ভয়ে তিনি পাঠশালায় যেতেন বটে। কিন্তু পাঠশালার চার দেয়াল তাঁর কাছে অসহ্য মনে হতো। তাই তিনি পাঠে অন্যমনস্ক ও উদাসিন থাকতেন। শ্লেটের উপর আঁকতেন ইক্াড়ি-বিক্াড়ি কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং। আর এজন্য কপালে জুটত শিক্ষকের শাসন। ফলে ধরাবাঁধা এ পড়াশুনার প্রতি তিনি হয়ে ওঠেন বীতশ্রদ্ধ। তাই তিনি গন্ডিবদ্ধ এই ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে অনতিদূরে শিবমন্দিরে গিয়ে সেতার বাজানো শুনতেন। টের পেয়ে তাঁর মা তাঁকে শাস্তি স্বরুপ ঘরের একটি খুঁটির সঙ্গে সারাদিন বেঁধে রাখতের এবং খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। প্রথমটায় খুব কান্না কাটি করলেন। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে সঙ্গীত হবে তাঁর একমাত্র সাধনার জগৎ। তাই তিনি কোনো এক গভীর রাতে সুযোগ মতো বাড়ি ছেড়ে পালালেন। অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে গিয়ে হাজির হলেন ঐশ্বর্যমন্ডিত শহর কলকতায়। জনৈক বিশ্বেশ্বর বাবুর সহযোগিতায় শিষ্যত্ব বরণ করলেন ওস্তাদ নুলো বাবুর। নুলো বাবু ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দু। তিনি মুসলমানের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতেন না। বিধায় বিশ্বেশ্বর বাবুর পরামর্শে বালক আলাউদ্দিন ‘মনোমোহন দেব উত্তরাঢ়’ নাম ধারণ করেছিলেন। আলাউদ্দিন নিখোঁজ হল সাড়ে সাত বছর কেটে গেল। পুত্র শোকে মাতা পিতা খুবই কাতর হয়ে পড়েছেন। পিতামাতার অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং নিখোঁজ ভ্রাতার প্রতি ভ্রাতৃ ¯েœহ ফকির আফতাবউদ্দিনকে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করলেন কলকাতার নুলোবাবুর বাড়ি। সদর দরজায় কড়া নাড়তেই তা খুলে দিল আলাউদ্দিন। ফকির আফতাবউদ্দিন কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন নির্বাক ও হতভম্ব হয়ে। তারপর বিকট চিৎকার দিয়ে বলে উঠনেল আলম প্রাণের ভাইটি আমার। আলাউদ্দিনও বড় ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনই শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলেন। দু’ভাইয়ের এ মিলন দৃশ্যে উপস্থিত সকলের চোখ অশ্রæসিক্ত হল। ইতিমধ্যে আলাউদ্দিন খাঁ মনোমোহন দেব উত্তরাঢ় নামে সঙ্গীত জগতে তার স্থান দখল করে নিয়েছিল। উক্ত ঘটনার পর তার আর ছদ্ম নাম ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি। সংকল্পে দৃঢ়, চেতনায় দীপ্ত থাকলে কত অসাধ্য যে সাধন করা যায় এবং একদিন সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ করা সম্ভব হয়। অজ পাড়া-গাঁ শিবপুরের ঘর পালানো আলম তার উজ্জল দৃষ্টান্ত। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ অসংখ্য রাগ সৃষ্টি করে গেছেন। অর্জন করেছেন বিশ্ব জোড়া খ্যাতি। পেয়েছেন বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি। তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ, বিশ্ব ভারতীয় দেশী কোওম, দিল¬ী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক প্রদত্ত সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রী, দিল¬ী একাডেমীর সঙ্গীত নাট পুরস্কার ও ফেলোশীপ সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান।
তাঁর উপদেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। তার মধ্যে চন্দ্রসারং ও মন্দ্রনাদের নাম উলে¬খ্যযোগ্য। সরোদ বাদ্যযন্ত্রের আধুনিক রূপ তাঁরই অবদান। তিনি অনেক রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করেন। হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘÑবাহার, প্রভাতকেলী, হেমবেহাগ, মদন মঞ্চুরী (মদিনা মঞ্জরী) ইত্যাদি তার সৃষ্ট রাগ-রাগিনীর মধ্যে বিশেষ উলে¬খযোগ্য। তাঁর অসংখ্য শিষ্যের মধ্যে উলে¬খ্য তাঁর পুত্র আলী আকবর খাঁ, কন্যা রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা), জামাতা রবিশংকর ও ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর খান। তাছাড়া বংশীবাদক পাল¬ালাল ঘোষ, সরোদ বাদক তিমির বরণ ও তাঁর পুত্র ইন্দ্রনীল, সরোদে শ্যাম গাঙ্গুলী ও শরণারাণী, সেতারে খাদেম হোসেন খান, নিখিল বন্দ্যোপধ্যায়, তবলা ও এসরাজে ফুলঝুরি খান প্রমুখ তাঁর শিক্ষণ প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন। তিনি আলাউদ্দিন ঘরানা সঙ্গীতের স্রষ্টা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *