বৃহস্পতিবার, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোনালী ব্যাংকের কনজ্যুমার লোন শিক্ষকদের ‘গলার কাঁটা’

মাহমুদ আলহাছান, জলঢাকা(নীলফামারী): পৃথিবীর করুণ দৃশ্যগুলোর একটি হচ্ছে, একজন পুরুষ মানুষকে প্রকাশ্য জনসমক্ষে কাঁদতে দেখা। আবার সেটি যদি হয় একজন শিক্ষকের কান্না তাহলে তা যুগপৎ কষ্টের ও লজ্জার।

জিকরুল ইসলাম একটি বেসরকারি হাইস্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক। সোনালী ব্যাংক জলঢাকা শাখায় আগস্ট মাসের বেতন তুলতে এসে দেখেন তার অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তার বেতনের পুরো টাকা ব্যাংকের কনজুমার লোন বাবদ কেটে নেয়া হয়েছে। তিনি অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার স্ত্রীর চিকিৎসা খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকাও তুলতে পারেননি। অশ্রুসজল চোখে ব্যাংকের নিচে নেমে তিনি কথাগুলো বলছিলেন।

এটি শুধু জনাব জিকরুল ইসলামের একার সমস্যা নয়, এই সমস্যাটি জলঢাকা উপজেলার প্রায় ৯০℅ বেসরকারি শিক্ষকের। হয়তো মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্যে কিংবা পরিবারের কারও চিকিৎসার প্রয়োজনে কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে সোনালী ব্যাংক থেকে নেয়া কনজুমার লোন এখন তাদের জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে গলায় আটকে আছে। পারছে না খুলতে, পারছে না বের হতে হতে।

প্রায় ১৪℅ সুদে নেয়া এই লোনের টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে এখন অধিকাংশ শিক্ষকের মাসের পুরো বেতনই ব্যাংক কেটে নিচ্ছে আর শিক্ষকগণ হাহাকার করে বাড়ি ফিরছেন।

আরেকজন সিনিয়র শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন এই প্রতিবেদকের কাছে তার আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংকে যেহেতু বাধ্য হয়ে লোন করেছি, ব্যাংক কিস্তি কেটে নিবে। কিন্ত তাই বলে একজন শিক্ষক ১ টাকাও বেতন তুলতে পারবে না। পুরো টাকাই ব্যাংক কেটে নিবে! শিক্ষকের কি পরিবার নেই, সন্তান সন্ততি নেই, তাদের কি ওষুধ পত্র কিনতে হয় না? এটা কি ধরনের অমানবিকতা! এমনও দেখা গেছে যে, কোনো কোনো শিক্ষক লজ্জার মাথা খেয়ে তাদের স্ত্রী কিংবা অসুস্থ সন্তানকে ব্যাংকে নিয়ে এসে ম্যানেজারকে অনুরোধ করেছেন। কিন্ত একজন শিক্ষকের এই অসহায়ত্ব ব্যাংক ম্যানেজারের হৃদয়ে কোনো রেখাপাত করেনি।

সিনিয়র শিক্ষক রত্নেশ্বর রায় বলেন, সোনালী ব্যাংক জলঢাকা শাখার ম্যানেজার এখন আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তা। তিনি চাইলে আমরা বেতন তুলতে পারি। আর না চাইলে কোনো উপায় নেই। তার মর্জির উপরেই এখন আমাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে।

অনেকেই হয়তো বলতে পারে যে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে, ব্যাংক কিস্তি কেটে নিবে, এটাই তো স্বাভাবিক! অথচ, এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। একটি পরিবার চলার মতো ন্যূনতম ব্যবস্থা না রেখে পুরো টাকা কেটে নেওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন সিনিয়র শিক্ষক সাইফুল ইসলাম।

সোনালী ব্যাংকের এই অমানবিকতার কারণে অনেক শিক্ষক স্থানীয় দাদন ব্যাবসায়ীদের শরণাপন্ন হচ্ছেন এবং জীবন বাঁচাতে চড়া সুদে ঋন গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। জলঢাকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব দাদন ব্যবসায়ী এমন সুযোগের জন্য হা করে তাকিয়ে থাকে।

উপজেলায় দরিদ্র বেসরকারী শিক্ষকদের আরেক মরণ ফাঁদের নাম ‘কালব’ (CCULB) নামের একটি এনজিও। শিক্ষকদের ঋণ দেয়ার নামে অত্যন্ত ভয়াবহ চড়া সুদের ফাঁদে ফেলে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করাই যেনো তাদের উদ্দেশ্য। ভয়ংকর মামলাবাজ এই এনজিওটি এ পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের প্রদত্ত ঋণের কয়েক গুন বেশি অংকের টাকার মামলা করে শিক্ষকদের হেনস্তা করে যাচ্ছে।

কালব থেকে ঋণ নিয়ে এবং মামলার শিকার হয়ে কত শিক্ষকের পরিবার যে পথে নেমেছে তার ইয়ত্তা নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী বলয়ের লোকজন কর্তৃক পরিচালিত এবং আওয়ামী আমলে প্রতিষ্ঠিত এই এনজিওটিকে বর্তমান বাংলাদেশের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বললেও কম বলা হয়।

বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন প্রদানকারী ব্যাংক এবং কালব মিলে শিক্ষকদের লাঞ্চিত ও অপমানিত করার বিষয়টি দেখার কি কেউ নেই? বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ছাত্র-জনতা কি এ বিষয়ে একটু নজর দিবে না? সরকার কি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না- প্রশ্ন ভুক্তভোগী শিক্ষকদের।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

, , বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *