সোমবার, ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

হার মানেননি কুষ্টিয়ার মারুফ, এখন তার ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা

জিয়াউল হক (খোকন), নিজেস্ব প্রতিবেদক: কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস ফুলতলা এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ (৪৬)। করণিক বাবার সংসারে অভাব অনটন আর নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ২ হাজার ৬০০ টাকা মাসিক বেতনে চাকরি শুরু করে নিজ দক্ষতা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়েছিলেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার। কিন্তু সেই সুখ মারুফের কপালে বেশি দিন টেকেনি। ২০০৬ সালে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায় এবং দুই পা অচল হয়ে যায়। 

বর্তমানে দুই হাতে দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে কোনো রকমে হাঁটতে পারেন মারুফ। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন ঘাটে-ঘাটে। কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনেছে সব কিছুই। হাসপাতালের বেড থেকে শুরু করেন রাইস মিলের যন্ত্রাংশ ও কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির ব্যবসা। নিজে হাঁটতে না পারলেও পরিশ্রমের মাধ্যমে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে এগিয়ে যাচ্ছেন মারুফ। প্রায় ৪০ কোটি টাকার মূলধন নিয়ে পরিচালনা করছেন গ্লোবাল সলিউশন মেশিনারি (জিএসএম) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২০০ মানুষ চাকরি করছেন। 

প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বারবার নির্বাচিত পরিচালক। সাইফুলের বাবা আবদুল জলিল সরকার ছিলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয়ের করণিক। মা হাসিনা বানু গৃহিণী। 

১৯৯৩ সালে এসএসসি, ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং ২০০৫ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিএ পাস করেন মারুফ। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মারুফ শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, তিনি এলাকার প্রতিবন্ধীদের প্রেরণা। প্রতিবন্ধীদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি নিজেকে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি চৌড়হাস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য। 

মারুফ নিজের মেধাশক্তি ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন কারখানার যন্ত্রপাতি তৈরি করে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আবার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা আদায়ের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অসংখ্য মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থী এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। 

জানা গেছে, ২০১২ সালে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকায় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে নিজের জমানো ও ধার করা টাকা দিয়ে ২২ কাঠা জমি কিনে একটি টিনশেডের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে রাইস মিলের  যন্ত্রপাতি ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ শুরু করেন। মাত্র তিন মাসে ৩৫ লাখ টাকা উপার্জন করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২২ কাঠার জায়গায় বর্তমানে সেখানে সাত বিঘা জমিতে বিশাল কারখানা করেছেন। সেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি। ধান কাটা, ধান মাড়াই-ছাঁটাই, ঘাস কাটা, বিচালি কাটা থেকে শুরু করে ভুট্টা ছড়ানোর যন্ত্রাংশ। 

জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মারুফ বলেন, মানুষের জীবনের চলার গতি যদি স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। পৃথিবীটা তার জন্য অনেক কষ্টের হয়। আবার সেই জায়গা থেকে যদি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় সেটা অনেক আনন্দের ব্যাপার। তাছাড়া সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে জীবন অনেক সুখের ও শান্তির হয়। একটা রাস্তা যেমন সোজা না, তেমনি মানুষের জীবনও সোজা না। তেমনিভাবে আমার জীবনের চলার পথটাও সহজ ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। ছোটবেলায় প্রাইমারি স্কুলে খালি পায়ে গেছি। তখন ইউনিসেফ থেকে স্কুল ড্রেস দিতো আমাদের। অনেক কষ্ট করে চলতে হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেছি। 

তিনি আরও বলেন, ডিপ্লোমা পাস করার পর ১৯৯৭ সালে ঢাকায় মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করি। সেই চাকরিটা আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিল। কারণ আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন কেরাণির সন্তান। মা-বাবার ছোট সন্তান ছিলাম। ৬ মাস পরে আমার বেতন বাড়িয়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা করা হয়। ডিপ্লোমা পাস করার পর জাপানি কোম্পানিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করি। ওই কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য আমি ২০০০ সালে সিঙ্গাপুর ও ২০০১ সালে  জাপানে গিয়েছিলাম। এরপর আমি অন্য আরেকটি বিদেশি কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করি। জাপানি আর ইন্ডিয়ান ওই কোম্পানিতে আমার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বেড়ে যায় এবং বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা সম্পন্ন হয়। তখন ওই কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পাই। 

পরে ২০০৬ সালের ৭ এপ্রিল একটা প্রাইভেট কারে করে আমি পাবনা থেকে কুষ্টিয়ায় ফেরার পথে ঈশ্বরদী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ি। একটা মোটরসাইকেলকে রক্ষা করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। এতে আমার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। দুর্ঘটনার ২১ দিন পর চিকিৎসক জানান, আমি আর দাঁড়াতে পারব না। পঙ্গুত্বের কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল। আমার যে অবস্থা ছিল তাতে আমি দাঁড়াতে পারার কথাও না। তবে ফিজিওথেরাপি, বিভিন্ন ব্যায়াম ও সাঁতার কেটে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে শারীরিক অক্ষমতার পরাজয় ঘটাতে পেরেছি। ধীরে ধীরে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম, এক সময় মহান আল্লাহর রহমতে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটাও শুরু করি। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে না পারলেও আমার মনোবল চাঙ্গা হয়। পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছি।

সাইফুল আলম মারুফ বলেন, ছয় মাসের মতো কোম্পানি সাপোর্ট দিয়েছিল। হাসপাতালের বেড থেকেই আমি বিজনেস শুরু করি। তখন আমি নিজে নিজেই সোর্সিং করতাম। সে সময় কুষ্টিয়ায় এতো ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ছিল না। অনেক কষ্ট করে করে কাজ করতাম। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করলাম এবং রাইস মিল, চামড়া শিল্প এবং তামাক শিল্পকে বেচে নিলাম। রাইস মিলের যন্ত্রাংশ দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। খুব কষ্ট করে মেশিনগুলো বিক্রি করতে হতো। আমার কোনো স্টাফ ছিল না। আমি একাই সব কাজ করতাম। মেশিন সেটআপ দেওয়ার জন্য আমাকে কোলে করে নিয়ে যেত সবাই। এভাবে ব্যবসা শুরুর তিন মাসে ৩৫ লাখ টাকা উপার্জন করে ফেললাম। তারপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে যেকোনো যন্ত্রাংশ উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের আছে। 

তিনি বলেন, সর্ব প্রথম ইতালি থেকে চারটি মেশিন নিয়ে আসি। একটু সুস্থ হওয়ার পর কয়েকজনকে সঙ্গে করে চায়না যাই। সেখান থেকে কিছু প্রোডাক্ট কিনি, ইন্ডিয়া থেকে কিছু প্রোডাক্ট কিনি। এভাবে কয়েক বছর চলার পর ২০১০ সালে কারখানা করার পরিকল্পনা করলাম। কারণ কিছু কিছু প্রোডাক্ট বিদেশ থেকে আনা অনর্থক মনে হতো। ২০১২ সালে জায়গা কিনলাম এবং কারখানা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে আমার কারখানা ও ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। আজ আমার প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী ২০০ জন মানুষ চাকরি করছে। আমাদের উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা কয়েকগুণ বেশি। আমাদের জমি, যন্ত্রপাতি, বিল্ডিং মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ইনভেস্ট হয়ে গেছে। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে কোম্পানির ভ্যালু প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো।  

সাইফুল আলম মারুফ বলেন, আমরা প্রান্তিক কৃষকদের হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছি। প্রথম থেকে অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে আসছি আমরা। বিদেশ থেকে যাতে কৃষি যন্ত্রাংশসহ কিনা না লাগে সেজন্য আমরা কাজ করছি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। 

জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শ্রমিক মাসুদ রানা বলেন, প্রায় ছয় থেকে সাত বছর ধরে আমি এখানে চাকরি করছি। চাকরির বেতনের টাকায় আমার সংসার সচ্ছলভাবে চলছে। আমাদের স্যার খুব ভালো মনের মানুষ। আমাদের সব ধরনের সমস্যায় স্যার আমাদের সহযোগিতা করেন। আমাদের কাজকাম খুব ভালো মতো চলছে। 

আরেক শ্রমিক মাহফুজ আহমেদ বলেন, আমি এখানে অনেক দিন ধরে চাকরি করছি। স্যার সব সময় আমাদের কাজের দেখভাল করেন। ক্রাচে ভর করেই নিজের কারখানায় আমার মতো শ্রমিকদের সঙ্গে কাজে হাত লাগান। স্যার খুব ভালো মানুষ। এখানে কাজের কোনো সমস্যা, ভুলত্রুটি হলে বা কাজ না বুঝলে স্যার আমাদের শিখিয়ে দেন। তার দিকনির্দেশনায় আমাদের কাজ খুব সুন্দরভাবে চলছে। এখানে কাজ করে আমরা খুব ভালো আছি। এখান থেকে যে বেতন পাই তা দিয়ে আমাদের সংসার খুব সচ্ছলভাবে চলে।

জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ম্যানেজার ওয়ারেশ হোসেন নয়ন বলেন, আমাদের স্যার খুবই পরিশ্রমী ও মানবিক মানুষ। উনার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমরা উনার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পেরে গর্বিত। স্যার প্রতিদিন সবার আগে প্রতিষ্ঠানে আসেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করেন। শারীরিক অক্ষমতা নিয়েও স্যার দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে চলেন। তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। স্যার তার নিজ প্রতিষ্ঠানকে যেমন ভালোবাসেন, আমাদেরকেও তেমন ভালোবাসেন।

চাল ব্যবসায়ীরা বলেন, জিএসএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মারুফ একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি অটো রাইস মিল সেক্টরের জন্য আশীর্বাদ। আগে যেসব যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আনা লাগত সেসব মেশিন তিনি উৎপাদন করছেন। এতে মিল মালিকরা উপকৃত ও লাভবান হচ্ছেন। অনেক সংগ্রাম করে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অনেক চ্যালেঞ্জিং পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রেরণা। 

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে সাড়া ফেলেছেন প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ। কৃষি খাত আধুনিকায়নের তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। নতুন নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ একজন সফল উদ্যোক্তা।

কুষ্টিয়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. আশানুজ্জামান বলেন, প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। তিনি রাইস মিলের যন্ত্রপাতি ও কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। চালকল মালিক ও কৃষকদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি শত শত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *