বুধবার, ৬ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২২শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

হেভি মেটাল, কাওয়াসাকি বাইক, রেসিং কারের ভক্ত জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী

যায়যায়কাল ডেস্ক: জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন কট্টর রক্ষণশীলই নন, তিনি হেভি মেটালের ভক্ত এবং নিজেও ড্রামার; আয়রন মেইডেন ও ডিপ পার্পলের মতো ব্যান্ডের অনুসারী। হেভি মেটালের পাশাপাশি তিনি কাওয়াসাকি মোটরসাইকেলেরও ভক্ত।

নিজের রাজনীতিক জীবনকে অনুপ্রাণিত করেছেন ‘আয়রন লেডি’ মার্গারেট থ্যাচারের আদর্শ থেকে। তার প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে পরেন নীল রঙের স্যুট। নতুন এই প্রধানমন্ত্রীর নাম সানায়ে তাকাইচি।

মঙ্গলবার সংসদে ভোটে জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

যেখানে জাপানের বেশির ভাগ রাজনীতিক ধনী ও অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসেন, সেখানে তাকাইচির বেড়ে ওঠা এক সাধারণ পরিবারে। তিনি বেড়ে উঠেছেন জাপানের নারা নামক অঞ্চলে। অঞ্চলটি মন্দির, উপাসনালয়, ঘন বন আর সবুজ পাহাড়ে পূর্ণ। তার মা পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন, আর বাবা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।

তাকাইচি টোকিওর অভিজাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তার মা-বাবা তাকে কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য চাপ দেন। এটি তার জন্মভূমি থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে অবস্থিত একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তার বাবা মায়ের ধারণা ছিল মেয়ে হওয়ায় তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রয়োজন নেই। তারা তার ছোট ভাইয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে চেয়েছিলেন।’

ছোটবেলা থেকেই তাকাইচি জাপানি নারীদের চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলে মনে করা হয়। ২০২৪ সালের একটি জীবনীতে তিনি স্মরণ করেন, তার মা তাকে বলতেন, ‘গাঢ় লাল গোলাপ হও’। অর্থাৎ ‘নারীসুলভ সৌন্দর্য ধরে রাখো, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কাঁটাও থাকুক।’

সত্তরের দশকের শেষ দিকে তরুণী তাকাইচি প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা ধরে বাস ও ট্রেনে চেপে পশ্চিম জাপানে অবস্থিত বাবা-মায়ের বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। তিনি চাইতেন, স্বাধীনভাবে আলাদা গিয়ে থাকবেন। কিন্তু তার মা প্রথমদিকে কঠোরভাবে আপত্তি জানান। বিয়ের আগে বোর্ডিংহাউসে থেকে পড়াশোনা করার অনুমতি পাননি তিনি।

তাকাইচিকে সহজে কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ে বেঁধে ফেলা যায়নি। একসময় তিনি জাপানে নারী হিসেবে রাজনীতিতে কাজ করার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছিলেন। এখন তিনি ঐতিহ্যবাদী ও পুরুষপ্রধান লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান।

তাকাইচি একদিকে জাপানের যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আবার অন্যদিকে বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চান। সাম্প্রতিক এক জনপ্রিয়তাবাদী ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়ায় এমন অবস্থান নিচ্ছেন, যা কিছুটা ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ ক্যাম্পেইনের আন্দোলনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

তাকাইচি জাপানের দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তার নেতৃত্বে জাপান আরও ডানপন্থার দিকে এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

‘জাপান ফিরে এসেছে’— এই বার্তা তিনি জোরালোভাবে প্রচার করছেন। এরসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের ভূমিকাকে একটু আলাদাভাবে পরিচিত করাচ্ছেন। এই নেত্রী অভিবাসন ও পর্যটনকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এখন তাকাইচি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট নিয়ে সৃষ্ট নতুন অনিশ্চয়তা সামলানোর ক্ষেত্রে এক বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে টোকিওতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে তার। ট্রাম্প শুল্ক আরোপ ও জাপানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির খরচ আরও বেশি বহনের পরামর্শ দিয়ে জাপানি কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছেন।

স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পর তাকাইচি ম্যাতসুশিতা ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে যোগ দেন। এটি তরুণ রাজনীতিক ও ব্যবসায় নেতাদের প্রশিক্ষণের জন্য পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান।

আশির দশকের শেষের দিকে কলোরাডোর সাবেক কংগ্রেসম্যান প্যাট্রিসিয়া শ্রোডারের অফিসে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে যান তাকাইচি। শ্রোডার ছিলেন একজন ডেমোক্র্যাট ও প্রবল নৃতত্ত্ববাদী নারী অধিকার সমর্থক।

১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিযোগিতা না করার ঘোষণা দেওয়ার সময় শ্রোডারের আবেগঘন বক্তব্য তাকাইচিকে স্পর্শ করেছিল। তিনি শ্রোডারকে একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান এবং তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় প্রতিযোগিতা করার জন্য উৎসাহিত করেন এবং সাহায্য করারও প্রতিশ্রুতি দেন।

ওয়াশিংটনে তাকাইচি ছিলেন উদ্যমী। সহকর্মীদের নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে। সেই সময় তার প্রতিরক্ষা বা সামাজিক বিষয়ে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কোনো ইঙ্গিত ছিল না। এসব কথা বলছিলেন শ্রোডারের সাবেক সহকারী অ্যান্ড্রিয়া ক্যাম্প।

জাপানে ফেরার পর তাকাইচি লেখক এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। নারা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যান। তার বাবা অবসরের সঞ্চয় তার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করেছিলেন।

পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকাইচি বলেন, তার পুরুষ সহকর্মীরা প্রায়ই তাকে গুরুত্ব দিতেন না, আর তারা যে আলোচনাগুলো করতেন, সেগুলো সাধারণত সাউনা বা সামাজিক ক্লাবে হতো, যেখানে নারী আইনপ্রণেতাদের যোগ দেওয়া সম্ভব হতো না।

১৯৯৩ সালে তিনি দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছিলেন, ‘একজন নারীর জন্য পুরুষের সঙ্গে একান্তে দেখা করা খুবই কঠিন। সবার নজর থাকে। আর আমি চাই না কোনো অদ্ভুত কেলেঙ্কারি তৈরি হোক। আমরা বিকেল ৫টার পরের সময়টা কাজে লাগাতে পারি না।’

পার্লামেন্টের শুরুর দিনগুলোতে তিনি শিনজো আবের সঙ্গে জোট গড়ে তুলেন। আবে ছিলেন অভিজাত পরিবার থেকে আসা আইনপ্রণেতা, যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জাতীয়তাবাদী। দুজনে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে আরও দেশপ্রেমমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সংযোজনের মতো বিষয়ে একমত ছিলেন।

২০০৬ সালে আবে তার প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তাকাইচিকে তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ঘটনা তাকাইচিকে জাপানি রাজনীতিতে সবচেয়ে দৃশ্যমান নারীদের একজন করে তোলে।

আবে তাকে ২০১২ সালে তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেও পুনরায় মনোনীত করেন, যা আট বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে তিনি আবের নীতির প্রবল সমর্থক হয়ে ওঠেন, যেমন— যুদ্ধোত্তর শান্তির নীতির পর সামরিক শক্তিকে স্বাধীন করতে সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা এবং সস্তা নগদ ও সরকারি সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি চালানোর পরিকল্পনা ইত্যাদি।

তাকাইচি ২০২১ সালে শিনজো আবে-কে পুনরায় নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তাকাইচি নিজেই নির্বাচনে নামেন। আবে তাকে সমর্থন দেন। তবে সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান এবং ২০২৪ সালের আরেকটি প্রচেষ্টাতেও সফল হতে পারেননি।

নারা শহরের একটি ট্রেন স্টেশনের বাইরে আবে বক্তব্য দেওয়ার সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তখন তাকাইচি ভেঙে পড়েন। তিনি তখন বলেন, ‘কখনো শারীরিক ও মানসিকভাবে আমার এতটা খারাপ লাগেনি।’

এরপর তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘আজ থেকে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, নাহলে আমাকে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’

গত সেপ্টেম্বরে শিগেরু ইশিবা ঘোষণা দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়বেন। তখন আবারও নেতৃত্বের জন্য হাত তোলেন তাকাইচি। তিনি চারজন পুরুষকে পেছনে ফেলে দলের সদস্যদের মধ্যে সমর্থনের ঢেউ ধরে রেখে ‘জনগণের উদ্বেগকে আশায় রূপান্তরিত করা’র বার্তা দেন।

যতই তাকাইচি রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত হতে থাকেন, তার ব্যক্তিগত জীবনও সামনে আসতে শুরু করে। ২০০৪ সালে তাকু ইয়ামামোতো নামে এক এলডিপি রাজনীতিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০১৭ সালে তার বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। এ নিয়ে তাকাইচি বলেন, রাজনৈতিক তর্ক তাদের ঘরোয়া জীবনেও চলত। এরপর ২০২১ সালে তারা আবার বিয়ে করেন। তখন ইয়ামামোতো তাকাইচির পদবী গ্রহণ করেন, যা জাপানের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিরল ঘটনা।

তাকাইচির নারা শহরের হেয়ারড্রেসার ইউকিতোশি আরাই তাকে বিখ্যাত ছোট চুলের স্টাইলের জন্য সাহায্য করেছিলেন। এই হেয়ারড্রেসার বলেন, তিনি চাইতেন তার চোখ ও কান দৃশ্যমান থাকুক, যেন দেখা যায় যে তিনি মানুষকে কথা বলতে দেখছেন এবং শুনছেন। তিনি মনে করেন, তাকাইচি মধ্য জাপানের কানসাই অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট্য—হাস্যরস ও বিনয় ধারণ করেছেন।

এক ব্রিটিশ মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে আরাই বলেন, আমি মনে করি না তিনি ‘আয়রন লেডি’। তার ভাবমূর্তি একজন কানসাই নারীর মতো।

চলতি মাসে এলডিপি প্রধান নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর তাকাইচিকে একটি টেক্সট দেন আরাই— তিনি যেন নিজের যত্ন নেন। দুই দিন পর তিনি জবাব দেন ‘এখন লড়াই শুরু হলো।’

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ